সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

ইয়াবার ভয়ঙ্কর বিস্তার

* এমপি প্রভাবশালী রাজনীতিকরাও জড়িত ব্যবসায় * ঘরে ঘরে মায়েদের কান্না

ইয়াবার ভয়ঙ্কর বিস্তার

মরণনেশা ইয়াবার ভয়ঙ্কর বিস্তার ঘটেছে সারা দেশে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দেশের সর্বত্র মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়েছে নীরব এই ঘাতক। ইয়াবার সর্বনাশা থাবায় লাখো পরিবারের সন্তানদের জীবন এখন বিপন্ন। এমন সন্তানদের মায়ের কান্না এখন ঘরে ঘরে। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে প্রসার ঘটছে ইয়াবা ব্যবসার।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, এমপি, রাজনৈতিক নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে। যে কারণে কোনো ভাবেই এর আগ্রাসন রোধ করা যাচ্ছে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংস করে মাদক ব্যবসার এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী শুধু নয়, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীদের একটি বড় অংশ এখন ইয়াবায় আসক্ত। সহজলভ্যতার কারণেই ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে বলে মনে করছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তাদের হিসাবেই দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা ৩০ লাখ। তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলেই মনে করেন অনেকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের সবচেয়ে ক্ষতিকর নেশা দ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা অন্যতম একটি। ইয়াবা অর্থ হলো ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। মেথ্যাম ফিটামিন, উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিনের সঙ্গে হেরোইন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ইয়াবা। এ নেশা দ্রব্য হেরোইনের চেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, ইয়াবা সেবন করার পর সাধারণত নির্ঘুমতা, চাঞ্চল্যতা ও শরীরে উত্তেজনা দেখা দেয়। ক্রমান্বয়ে আসক্ত হওয়ার পর এটা মানব শরীরে নানা প্রকার ক্ষতি করে থাকে। মনে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তারও উদ্ভব হতে পারে। এ ছাড়া এটি আচরণগতভাবে সহিংস করে তুলতে পারে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা ক্রমশ সহিংস হয়ে উঠছে ইয়াবার প্রভাবেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনীতিকরা এই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কক্সবাজার জেলা পুলিশ, বিজিবি ও পুলিশের বিশেষ শাখার একাধিক গোপন প্রতিবেদনে ইয়াবা ব্যবসার জন্য টেকনাফের (কক্সবাজার-৪) এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রহমান বদিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এমপির পাঁচ ভাই ও তার স্বজনরা ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। তাদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা। সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয় মিয়ানমার সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সংসদ ও দেশটির শান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মংডু ও বুচিডং এলাকার সীমান্তরক্ষী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, কাস্টমস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করছেন। এ জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৫টি স্থানে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।   

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান বলেন, মাদক পাচার বন্ধে ভারতের সঙ্গে চুক্তির পর ফেনসিডিল পাচার কমে গেছে। ভারত সরকার বাংলাদেশের সীমান্তে অবৈধ ফেনসিডিল কারখানাগুলো উচ্ছেদ করেছে। এখন কূটনীতিক মাধ্যমে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে ইয়াবা পাচার কমে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শহর থেকে অজোপাড়া গাঁ পর্যন্ত সব স্থানেই এখন হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ‘ক্রেইজি ড্রাগ’ ইয়াবা। মোবাইল ফোনে অর্ডার দিলেই মুহূর্তেই হাতে চলে আসছে ছোট আকারের হরেক রঙের এই মাদক দ্রব্য। এ ছাড়া এখন পাওয়া যাচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু টং ও মুদি থেকে শুরু করে বড় বড় দোকানগুলোতেও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় সুচারুভাবে চলছে এই মাদক ব্যবসা। সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ইয়াবার খুচরা ব্যবসায়ীরা মাঝে মধ্যে গ্রেফতার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল হোতারা। এতেকরে ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা ব্যবসা। বানের পানির মতো দেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান। আর যারা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদেরও আটকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে আসছে কারাগার থেকে। ফিরছে ইয়াবা ব্যবসায়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মিয়ানমারে স্থাপিত ৭টি ইয়াবার কারখানা থেকে ইয়াবা সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন এই ৭টি কারখানায় ইয়াবা উৎপাদন করা হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্ত গলিয়ে চোরাইপথে এসব ইয়াবা আসছে টেকনাফে। সেখান থেকে আসছে কক্সবাজার। আর এসব চালান সংগ্রহ করছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়াসহ পাশের এলাকার কিছু প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী। তারাই রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানায়, আশি দশকের শুরুতে ‘ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি’ নামের একটি সংগঠন কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা তৈরি শুরু করে। ওই সময় বাংলাদেশে ইয়াবার তেমন পরিচিতি ছিল না। কিন্তু ৯০ দশকে মাদক দ্রব্যটি বাংলাদেশের এক শ্রেণির উচ্চাবিলাষী সেবনকারীদের প্রিয় হয়ে ওঠে। যার সূত্র ধরে টেকনাফের হাজী বশরের পুত্র বহুল আলোচিত একটেল রমজান ও বার্মাইয়া শুক্কুর নামের দুজন হুন্ডি ব্যবসায়ী ২০০০ সালের শুরুতে বাংলাদেশে ইয়াবা আনতে শুরু করে। তাদের হাত ধরে সম্প্রসারিত হয় বাংলাদেশের ইয়াবা পাচার। হালে মাদক সাম্রাজ্য শাসন করছে এই ইয়াবা। ইয়াবার ব্যাপক চাহিদার কথা বিবেচনা করে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু শহর ও তার আশপাশে কারখানায় তৈরি হচ্ছে ইয়াবা। সূত্র জানায়, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের মংডু শহরের এসব কারখানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াবার এসব কারখানায় ৫ প্রকার ইয়াবা বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। এগুলো এস ওয়াই, জিপি, এন ওয়াই, ডব্লিউ ওয়াই ও গোল্ডেন নামে পরিচিত। ইয়াবার বিত্তভিত্তিক নেটওয়ার্ক শুরু হয় নগরীর গুলশান-বারিধারা থেকে। পরে বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এসব নেটওয়ার্কে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জড়িয়ে পড়ে। অভিজাত এলাকাগুলোর ক্লাব, রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ টার্গেট করে বিস্তারকারীরা। বিত্তশালীদের এই নেশা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। 

রাজধানী ও টেকনাফে দেড় কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার : রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গতকাল পৃথক অভিযানে পুলিশ ১ হাজার ১০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ তিনজনকে আটক করেছে। এ ছাড়া টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীতে মাছ ধরার নৌকা থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। চকরিয়া থেকেও ২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ইয়াবার মূল্য দেড় কোটিরও বেশি টাকা। রাজধানীতে আটকরা হলেন সোহেল আহমেদ, সেলিম ও পারভেজ হায়দার। কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীতে মাছ ধরার নৌকা থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া জব্দ করা হয়েছে বিহিঙ্গী জালসহ নৌকা। এসব মালামালের মূল্য প্রায় ১ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বলে জানিয়েছে বিজিবি। সূত্র জানায়, টেকনাফ বিওপি চৌকির টহল সদস্যরা গতকাল সকালে নাফ নদীর খায়ুকখালী এলাকায় মাছ ধরার নৌকায় অভিযান চালায়। এ সময় নৌকার লোকজন নদীতে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়।

সর্বশেষ খবর