শনিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

শিশুচোর সিন্ডিকেটের কবলে হাসপাতাল ক্লিনিক

হাইকোর্টের আদেশ, র‌্যাব-পুলিশের অব্যাহত অভিযান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিভিন্নরকম তৎপরতার পরেও নবজাতক চুরির ঘটনা থামছেই না। হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে একের পর এক শিশু চুরির ঘটনা বেড়েই চলেছে। আগে রাজধানীর হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শিশুচুরির ঘটনা ঘটলেও ইদানীং এর দৌরাত্ম্য সারা দেশেই বিস্তৃত হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাঞ্চল্যকর শিশু চুরি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে রংপুর, সিলেট, বরিশাল ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকেও বেশ কয়েকটি শিশু চুরির ঘটনায় অভিভাবকরা তটস্থ হয়ে পড়েছেন।
অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক ও নার্সিং হোম ঘিরে ‘বহিরাগত আয়া’দের সমন্বয়ে শিশু চুরি ও বেচাকেনার শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড থেকে চুরি করা শিশুদের বিক্রি করছেন অহরহ। বড়জোর তিন-চার হাজার টাকা, এমনকি এর চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে ছেলে কিংবা মেয়ে শিশু। সামান্য বখশিশের বিনিময়ে গ্রাহকের পছন্দমাফিক ‘নবজাতক’ পাল্টে দেওয়ার অপকর্মও করছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আজিমপুর মাতৃসদন ও মাতুয়াইলের মাতৃমঙ্গল হাসপাতালে দালালদের মধ্যস্থতায় নবজাতক চুরি, রদবদল ও বেচাকেনার ব্যবসা জমে উঠেছে মর্মে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরে অভিযোগ রয়েছে। শুধু এই তিন হাসপাতাল-মাতৃসদনই নয়, রাজধানীর অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম ঘিরে নবজাতক চুরি ও বিক্রি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। ইদানীং পাড়া-মহল্লা থেকেও বিভিন্ন কৌশলে শিশু চুরির ঘটনা ঘটছে। সংঘবদ্ধ শিশুচোর ধরা পড়লে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চোরকে গণপিটুনি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। থানায় সোপর্দ করলেও চোর সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের সন্ধানে পুলিশের আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
শিশু চুরি : মায়েদের আতঙ্ক কাটছেই না : টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা বা অন্য কোনো দামি জিনিসপত্র চুরি নয়, হাসপাতাল থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে খোদ নবজাতক। একের পর এক শিশু চুরির ঘটনায় হাসপাতালগুলোর নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানেও নেমেছেন। কিন্তু তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ বলছে, ওয়ার্ডগুলোয় বহিরাগত আয়াদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বিভিন্ন স্টাইলে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি ও শিশু বিভাগের সামনে আছে সিসিটিভি ক্যামেরা, প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনে আছে নিরাপত্তাকর্মী। তবুও সম্প্রতি বাচ্চা চুরির ঘটনা ঘটে। ফলে কোনো কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না প্রসূতি মায়েরা। নিশ্চিত কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই তাদের উদ্বেগ-আতঙ্ক কাটছে না।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অস্ত্রোপচার হয় রুবিনা বেগমের। প্রথমবারের মতো মা হলেন তিনি। জন্ম দিয়েছেন এক মেয়ে সন্তানের। কিন্তু অচেতন থাকায় সে কথা জানেন না তিনি। তাকে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী পরিচর্যা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সদ্যোজাত শিশুটিকে তুলে দেওয়া হয় নানীর কোলে। মেয়ের মুখ দেখে আবেগাপ্লুত বাবা ছোটেন স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে। নানীও ব্যস্ত হয়ে পড়েন নাতনির পরিচর্যায়। এ সময় পাশে এসে শিশুটিকে আদর করতে শুরু করেন এক অপরিচিত নারী। বেলা তখন ১টা। নানী ওয়ার্ডের ভিতরে যান শিশুটির জন্য পরিষ্কার কাপড় আনতে। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন সেই নারীও নেই, নাতনিও নেই। হাহাকার করে ওঠেন রুবিনার মা। সোমবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এভাবেই চুরি হয়ে যায় রুবিনার শিশুটি। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার হলে বাদ-প্রতিবাদের মুখে র‌্যাব-পুলিশ মাঠে নামে। দুই দিনের মধ্যেই র‌্যাব-৫ অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং শিশু চুরির দায়ে অভিযুক্ত এক নারীকেও আটক করতে সমর্থ হয়। অতিসম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া এক নবজাতককেও র‌্যাবের তৎপরতায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু চুরির ঘটনায় একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
চার মাসে ১৮ নবজাতক চুরি : প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা ও নিরাপদ সন্তান প্রসব সুবিধার আড়ালে শিশু বেচাকেনার এই ঘৃণ্য কারবার চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। হাসপাতালসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র আরও জানায়, গেল বছরের শেষ চার মাসেই রাজধানীসহ দেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো থেকে অন্তত ১৮টি নবজাতক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ১১টি এবং ঢাকার বাইরে সাতটি শিশু চুরির ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আজিমপুর মাতৃসদন, মিটফোর্ড ও মাতুয়াইল মাতৃমঙ্গল হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে বরাবরই ধারণক্ষমতার তিন-চার গুণ বেশি রোগী অবস্থান করে। এদের মধ্যে প্রসূতি মায়েদের সংখ্যাই বেশি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেড় বছরে এ চার হাসপাতালে ৪৮৩টি শিশুর জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭টি ছিল মৃত এবং জন্মের পরপরই মারা যায় আরও ২৭ নবজাতক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহিরাগত আয়া মমতা বেগম জানান, বর্তমানে বাচ্চা চুরির ঘটনা কম ঘটে। কড়াকড়ি থাকায় বাচ্চা চুরি করার ঝুঁকি ইদানীং নিতে চায় না কেউ। তবে নবজাতক বদল করার অভিনব কায়দা-কৌশল চালু হয়েছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। ঢাকার সরকারি হাসপাতাল, মাতৃসদন, ক্লিনিকসহ প্রাইভেট হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোয় এ ব্যবসা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নবজাতক চুরি ও বেচাকেনার কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সসহ স্থায়ী কর্মচারীরা বরাবরই বহিরাগতদের দায়ী করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহিরাগত আয়া আয়মনতারা, নিলুফার ইয়াসমীন, সুলতানা রাজিয়াসহ কয়েকজন পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ডাক্তার-নার্সদের সহযোগিতা ছাড়া গাইনি ওয়ার্ড থেকে নবজাতক চুরি ও বেচাকেনার ব্যবসা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তারা নিজেদের ২০-২২ বছরের পুরনো আয়া দাবি করে বলেন, এমন জঘন্য কাজে প্রকৃত আয়ারা কেউ জড়িত নন।
আটকে রাখা যায় না : শিশুচোরদের হাতেনাতে আটক করে মামলা দিয়েও জেলে আটকে রাখা সম্ভব হয় না। আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা দ্রুতই জামিনে বেরিয়ে আসেন। আবার আস্তানা বদলে একই জঘন্য কাজে মেতে ওঠেন। রাজধানীতে নবজাতক চুরির ‘গডমাদার’ হিসেবে চিহ্নিত দীপালির আস্তানায় নবজাতক বেচাকেনা আর রদবদল ঘটানো হয় হামেশা। মাত্র চার বছরের তৎপরতায়ই দীপালি ও তার সহযোগীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড ও আজিমপুর মাতৃসদন থেকে অন্তত ৩০টি নবজাতক চুরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা হলেন নিলুফা বেগম (৩৫), মুন্নী আক্তার (২৮) ও নাসিমা বেগম (৩২)। ইসমত আরা দীপালির বাসায় শিশু বিক্রির দরদাম চলাকালে নবাবপুর থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে এ চক্রের চারজনকে আটক করে। কিন্তু দুই সপ্তাহ না পেরোতেই সেই দীপালি ও তার সহযোগীরা কোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন তারা আস্তানা বদলে ফেলায় পুলিশ আর খুঁজে পাচ্ছে না। অতিসম্প্রতি শিশু চুরির ঘটনায় তোলপাড় হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অভিযান চালিয়ে শিশুচোর চক্রের চার সদস্যকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়। তারা হলেন কোহিনুর বেগম (৩৫), ঝর্ণা বেগম (৩০), রেণু আক্তার (২৮) ও নূরজাহান বেগম (৩৮)। ভুয়া নার্স-আয়ার পরিচয়ে তারা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়ান এবং সুযোগ পেলেই নবজাতক চুরি করে নিয়ে যান। এর আগে বিভিন্ন সময় চুরিকৃত নবজাতকসহ তারা বার বার আটক হলেও অদৃশ্য ইশারায় শীঘ্রই ছাড়া পেয়ে আবার শিশু চুরির কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। ঢামেক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. নাজমুল হাকিম শাহীনের নেতৃত্বে একটানা দুই ঘণ্টা অভিযান চলে। জরুরি বিভাগ ও প্রসূতি ওয়ার্ডের আশপাশে ওতপেতে থাকাবস্থায় ওই চারজনকে আটক করা হয়।
শিশুদের কোড : জামাই-বউ
জামাই-বউ কেনাবেচায় সক্রিয় সিন্ডিকেট। জামাইয়ের দাম লাখ টাকা, আর বউয়ের দাম মাত্র ৩০ হাজার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও আজিমপুর মাতৃসদনকে ঘিরেই চলছে এ ‘জামাই-বউ’ বেচাকেনার জমজমাট আসর। শিশুচোর সিন্ডিকেটের কাছে নবজাতক ছেলের সাংকেতিক নাম ‘জামাই’, আর কন্যাশিশুকে ‘বউ’ হিসেবেই ডাকে তারা। বাজারে জামাইয়ের কদরই বেশি। লাখ টাকার কমে বেচাকেনা হয় না বললেই চলে। তবে ৩০ হাজার টাকা কমে বউও মেলে না। নবজাতক বিকিকিনি বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে মিলেছে এমন তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোর একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ওয়ার্ডমাস্টারের যোগসাজশেই হচ্ছে এসব। নবজাতক কেনাবেচায় ছেলেশিশুর চাহিদা বেশি হলেও ‘সুশ্রী’ মেয়েশিশুর চাহিদাও নেহাত কম নয়। নিঃসন্তান ধনাঢ্য দম্পতিরা নবজাতক কেনাবেচার চক্রের কাছে জামাই-বউ পেতে অগ্রিম অর্থ ‘বায়না’ করেন। বায়নার টাকা হাতে নিয়েই সিন্ডিকেট সদস্যরা চাহিদামাফিক শিশু চুরির জন্য টার্গেট নিয়ে মাঠে নামেন। পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, নবাব কাটারা রোড, নাজিম উদ্দিন রোড, নিমতলী, আজিমপুর, নবাবগঞ্জ কমিউনিটি সেন্টার এলাকার বেশির ভাগ ম্যাটারনিটি সেন্টারে আড়ালে-আবডালে চলছে এ ব্যবসা। শিশু চুরির পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী বাগিয়ে নেওয়ার কাজও করেন বহিরাগত কথিত আয়ারা। শিশু পাচারকারীদের কয়েকজন নিজেরাই এখন ম্যাটারনিটি ক্লিনিক খুলে বসেছেন। তবে এসব ক্লিনিকের কোনো সরকারি অনুমতিপত্র নেই। সিন্ডিকেট সদস্যদের পেছনে প্রভাবশালী মহল সম্পৃক্ত থাকায় থানা-পুলিশ করেও সন্তানহারা অভিভাবকরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না। বরং সন্তানহারা বাবা-মা আইনের আশ্রয় নিয়ে ‘ঝামেলা’ করতে চাইলে শিশুচোরেরা ‘মৃত শিশু’ জন্ম দেওয়াসংক্রান্ত কাগজপত্র প্রস্তুত করে তা মোকাবিলা করেন। ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড ও আজিমপুর মাতৃসদনসহ নগরীর কয়েকটি ক্লিনিক ও নার্সিং হোমে সরেজমিন অনুসন্ধানকালে নবজাতক চুরি, বদলানো ও কেনাবেচার বিভিন্ন তথ্য জানা গেছে। হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড থেকে বিভিন্ন কৌশলে নবজাতক চুরি করে আয়ারা এসব চিহ্নিত ক্লিনিকে পৌঁছে দেন। সেখানে কয়েক দিন লালন-পালনের পাশাপাশি চলে ক্রেতা সন্ধান।

সর্বশেষ খবর