শনিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্যাংকিং খাতে স্থবিরতা

শেয়ারবাজারে মূলধন কমেছে ১৪ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংকিং খাতে স্থবিরতা

সারা দেশে হরতাল-অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংকিং খাতে। ফলে প্রতিদিন কমছে ব্যাংকের স্বাভাবিক লেনদেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ঋণ আদায়ে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। অবরোধের কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে স্বাভাবিক গতি না থাকায় খেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ব্যাংকাররা বলছেন, ২০১৩ সালে বড় ধরনের ধাক্কা গেছে ব্যাংক খাতে। ফের সহিংস পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলবে। ব্যাংকের পরিস্থিতি খারাপ হলে পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের প্রতিদিনের লেনদেন কমেছে প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ। সাধারণ ব্যাংকিং তুলনামূলক স্বাভাবিক থাকলেও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোর টাকা নেওয়ার প্রবাহ কিছুটা কমেছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে প্রতিদিনের ব্যবসায়িক লেনদেনে।
বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে প্রতিদিনই ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকের লেনদেনে নিুমুখী প্রবণতা ছিল। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে এটিএম বুথ ও বিভিন্ন শাখায় টাকা পরিবহনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। এনসিসি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, এটিএম বুথে টাকা সরবরাহের জন্য পুলিশি নিরাপত্তা অন্যান্য সময়ের মতো পাওয়া যায় না। অবরোধের দায়িত্ব পালন করা পুলিশ ব্যাংকগুলোকে সময় অনুযায়ী সাপোর্ট দিতে পারে না। চলতি মাসের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় একদিনে আন্তঃব্যাংকিং লেনদেন হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এই লেনদেন নেমেছে মাত্র ৪০০ কোটি টাকায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের লেনদেনও ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের যেখানে গড় লেনদেন ছিল ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত সপ্তাহে তা ৪ হাজার কোটি টাকা নিচে নেমেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে শঙ্কিত বোধ করছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, অনেক ঋণগ্রহীতা পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাংকগুলোকে ইতিমধ্যে অবহিত করছে। তার মানে আগামী কিস্তি পরিশোধের সময় তারা সমর্থ নাও হতে পারেন, যা ব্যাংকগুলোর জন্য খুবই হুমকি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা ব্যাংকের এমডি মো. নুরুল আমিন বলেন, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ব্যাংক গ্রাহক বেশির ভাগ ব্যবসায়ী পণ্য ঠিকমতো বাজারজাত করতে পারছেন না। অন্যদিকে ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহনের খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব সার্বিক ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে পড়েছে। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামীতে ব্যাংক মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর এর প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে। খেলাপির পরিমাণ আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে চিন্তায় সব ব্যাংকারই শঙ্কিত বোধ করছেন। আল আরাফাহ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি দিন দিন উদ্বেগজনক পর্যায়ের দিকেই যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে অথবা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এর ফলে ঋণ খেলাপির পরিমাণ আবার বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি কারও কাম্য হতে পারে না।
শেয়ারবাজারে মূলধন কমেছে ১৪ হাজার কোটি টাকা : প্রতিদিন কমছে শেয়ারবাজার সূচক। ফলে বাজার পরিস্থিতি তলানির দিকে যাচ্ছে। গড় লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকায়। অবরোধ চলাকালীন ২০ দিনের লেনদেনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময়ে ডিএসই সূচক ২৫০ পয়েন্টের বেশি কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বাজারে তালিকাভুক্ত প্রত্যেক কোম্পানির শেয়ার দরই কমছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সব সম্বল হারাবেন।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও ৬ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে সূচক কমছে। শেয়ারবাজারের সব সূচকই এই সময় কমেছে। ৫ জানুয়ারি ডিএসইর সূচক ছিল চার হাজার ৯৬৯ পয়েন্ট। সর্বশেষ তা কমে চার হাজার ৭২৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে ডিএসইর গড় লেনদেন যেখানে ছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। গত তিন সপ্তাহে তা নেমেছে ২০০ কোটি টাকায়। তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ার দরই এ সময় কমেছে। বিএনপি জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধের মধ্যে লেনদেন হয়েছে ২০ দিন। এই সময়ের মধ্যে ডিএসইর বাজার মূলধন হারিয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি মাসের শুরুতে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ২৯ জানুয়ারি তা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে একই সময়ের ব্যবধানে সূচক কমেছে প্রায় ৪০০ পয়েন্ট। মাসের শুরুতে সিএসই সূচক ছিল নয় হাজার ১৩১ পয়েন্টে। সর্বশেষ কমে আট হাজার ৭৩৬ পয়েন্টে পৌঁছেছে। বাজার মূলধন কমেছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিএসইর সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই নাহরিন বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় শেয়ারবাজার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এভাবে সহিংসতা চলতে থাকলে শেয়ারবাজারের উন্নয়ন হবে না। মানুষের যে আস্থা তৈরি হচ্ছিল সেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও তাদের মূলধন হারাচ্ছে।  অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে শেয়ারবাজার একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে শেয়ারবাজারে সবারই মূলধন হারাতে হবে। এর পরিণতি পুরো শিল্প খাতকে অস্থিতিশীল করে দিতে পারে।

সর্বশেষ খবর