বুধবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা
কলকাতার চিঠি

মমতাদেবীর ঢাকা সফর ও কিছু কথা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতাদেবীর ঢাকা সফর ও কিছু কথা

শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন না ঘটলে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যিনি বর্তমানে ‘বঙ্গেশ্বরী’ নামে অধিক পরিচিত, ১৯ ফেব্র“য়ারি চার দিনের সফরে ঢাকায় যাচ্ছেন। এই সফর তিনি নিজেই চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে। এ পর্যন্ত যে তালিকা পাওয়া গেছে, ৫০ জনের কিছু বেশি লোক তার সঙ্গে যাচ্ছেন। প্রতিনিধিদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রতিনিধি দলে আছেন পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকারা। থাকতে পারেন কিছু প্রযোজক-পরিচালকও। ঢাকায় এত লোকের নিরাপত্তা নিয়ে ইতিমধ্যে দিল্লিতে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলেছে, তিনি যখন সৌজন্য সফরেই যাচ্ছেন তখন এত লোক কেন? ভারতের বিদেশনীতির অঙ্গ হিসেবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বিদেশ সফরে গেলে তাদের খরচ-খরচা বহন করেন যিনি যান তিনিই। নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক মহল থেকে ইতিমধ্যে এ সফরকে কেন্দ্র করে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রবীণ কূটনীতিবিদরা মনে করেন, মমতাদেবী ছাড়া আর কয়েকজন সহকর্মী  শীতের আমেজ উপভোগ করতে মেঘনা নদীতে ভ্রমণ করতে পারেন। তিনি দ্বিপক্ষীয় কোনো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তাহলে এত লোক নিয়ে তিনি কী করতে চাইছেন? তিনি কোনো সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে ঢাকার সঙ্গে চুক্তি করতে পারেন না। সেটাও ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় বিষয়। কলকাতার রাজনৈতিক সূত্রে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন মমতা। তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, জামায়াত-বিএনপি জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তিনি দেখা করার পরিকল্পনা করেছেন। সেটার অনুমতি বাংলাদেশ সরকার দেবে কিনা সেটা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। এ নিয়ে ইতিমধ্যে দিল্লি ও কলকাতার নানা সূত্র থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ (আগামী মাসেই তার ঢাকার কার্যকাল শেষ) ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এ সফরসূচি নিয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করছেন। শরণ ও মিত্র দুজনই চার-পাঁচ বছর সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সচিবালয়ে কাজ করেছেন। সেই সুবাদে এই সফরের সূচনা কিনা সে ব্যাপারে নানা মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কূটনৈতিক মহল থেকে বলা হয়, ’৭১ সাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাতে চিড় ধরিয়েছেন মমতাই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দিল্লি ও ঢাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য উভয় দেশের বকেয়া সমস্যাগুলো মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। ২০১২ সালে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে ঢাকা সফর করেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সে সময় মনমোহনের সফরসঙ্গী হননি। উল্টো তিনি এমন সব মন্তব্য করেছিলেন যাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে। যেমন তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি নিয়ে বিরোধিতার পাশাপাশি বিতর্কিত মন্তব্যও করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক সময়কার রাজাকার, বর্তমানে তৃণমূলের অনেক নেতাই প্রকাশ্যে টিভির পর্দায় বলেছেন, হাসিনাকে জেতানোর জন্য এসব চুক্তি করতে আমরা দেব না। যদিও চুক্তি আটকানোর কোনো ক্ষমতাই মমতার নেই। তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র। এপারের রাজাকারদের ভোটব্যাংক নিজের দিকে টানার জন্য এ কাজ তিনি করেছিলেন কিনা সে প্রশ্নও সে সময় উঠেছিল। তিস্তা চুক্তির জন্য মমতার সমর্থনের কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু কিছু নদী (তিস্তাসহ) পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে গেছে তাই সৌজন্যের খাতিরে ড. মনমোহন সিং নিজে তাকে টেলিফোন করেন। তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে তিন-তিনবার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন।
শেষবার যখন মেনন কলকাতায় আসেন সে সময় মমতার সঙ্গে তার বৈঠক হয় মাত্র সাত মিনিটের। মমতা গোঁ ধরে বলেছিলেন তিনি নিজে ঢাকা যাবেনও না, তিস্তা চুক্তি করতেও দেবেন না। কেন তা করেছিলেন তা তিনি নিজে কখনো প্রকাশ্যে বলেননি। তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে নানা সময় নানা কথা বলে বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন, বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক মাসের মধ্যে জিয়াউর রহমান ফারাক্কার জল পাওয়ার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সেদিন রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের আলোচনায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন কেন্দ্রের তৎকালীন মন্ত্রী প্রয়াত বরকত গনি খান চৌধুরী। সাধারণ পরিষদ তার বক্তব্য শুনে জিয়ার প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে বলেছিল এটা দ্বিপক্ষীয় বিষয়। ঢাকা আর দিল্লিকেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিল্লি বিষয়টি নিয়ে খুবই গুরুত্ব দেয়। শেখ হাসিনা তার প্রয়াত সেচমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাককে আলোচনার জন্য দিল্লিতে পাঠান। তিনি ভারতে এসে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং বরকত গনি খান চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করেন। উভয়েই ঢাকার সঙ্গে এই চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে এসে ৩০ বছরের জন্য এই চুক্তি করেন। উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা আরও দৃঢ় এবং শক্তিশালী হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার বাধা দেওয়াটা বাংলাদেশের কাছে একটা বড় আঘাত। সে দেশের জনগণও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এর প্রতিক্রিয়াও ভারতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশে মমতার এহেন কাণ্ডে তার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের লোকও রক্ত দিয়েছে। অথচ এই সুসম্পর্ক ভাঙার জন্য মমতা যে কেন উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা এখন জলের মতো পরিষ্কার। ঢাকা সফরকালে মনমোহন সিং যে আহত হয়েছিলেন তা তিনি গোপন করেননি। দিল্লিতে ফিরে এসে তিনি বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন বিরোধী তিন নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলিকে সমগ্র বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তারা মনমোহনকে প্রতিশ্র“তি দেন, এ ব্যাপারে তারা সরকারের পাশেই থাকবেন। বর্তমানে তারা সরকারে আছেন। কূটনৈতিক মহলের বিশ্বাস আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মোদি সরকার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। সীমান্ত চুক্তি বিষয়টিও পর্যালোচনা করা দরকার। ঢাকা যাওয়ার আগেই সীমান্ত চুক্তি নিয়ে সংশোধনী বিলটি রাজ্যসভায় তোলা হয়। তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সালমান খুরশিদ। তিনি যখন বিলটি পাঠ করছিলেন তখন তার হাত থেকে বিলটি কেড়ে নেন তৃণমূলের তিন সদস্য- কুণাল ঘোষ, ডেরেক ও ব্রায়েন এবং সঞ্জয় বসু। বিলটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে মনমোহনের মুখের ওপর ছুড়ে দেন তারা। বিলটি এখনো রাজ্যসভায় পাস হয়নি। দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়, এ মাসের শেষে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। বিলটি আলোচনার জন্য আসবে। বিলটি নিয়ে তার আগ্রহের কথা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা এবার আর রাজ্যসভা-লোকসভায় তৃণমূল সদস্যরা বিলটিতে বাধা দেওয়ার সাহস পাবে না। যারা সেদিন বাধা দিয়েছিলেন তারা অধিকাংশই সারদা-মামলায় জড়িত।
ছিটমহল বিনিময় নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। উপরে যে বকেয়া সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো তা কোনো অঙ্গরাজ্যের এখতিয়ারে পড়ে না। এটা কেন্দ্রীয়  সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। সুতরাং এ ব্যাপারেও মমতার কিছুই করার নেই। উভয় দেশের সম্পর্কের উন্নতি করার জন্য ভারতকেই বেশি উদ্যোগ নিতে হবে- এটাই ভারত-বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞদের ধারণা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন সেখানে কোনো বিষয়েই চুক্তি করার কোনো অধিকার তার নেই। তার ঢাকা সফর সফল হবে কি হবে না তিনি শেখ হাসিনাকে তিস্তা নিয়ে বাধা দেবেন কিনা এসব ভবিষ্যৎই বলবে। সুতরাং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। বর্ধমানের খাগড়াগড় কাণ্ড, সারদা কাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশি সংবাদ মাধ্যম প্রশ্ন তুলবে। তিনি সে সময় কী উত্তর দেন সেটাও অন্যতম বিচার্য বিষয়। খাগড়াগড় ও সারদা কাণ্ডের রেশ যে কতদূর গড়াবে তা এখনই বোঝা খুবই দুষ্কর। লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর