সোমবার, ২ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
১৮ মাসে ১৪ খুন

ধরাছোঁয়ার বাইরে উগ্রপন্থি খুনিরা

ধরাছোঁয়ার বাইরে উগ্রপন্থি খুনিরা

একের পর এক হত্যা করে লাপাত্তা খুনিচক্র। এরা ছদ্মবেশ নিয়ে ঘরে ঢুকছে। জবাই করে হত্যার পর বেরিয়ে যাচ্ছে। কখনো এরা হিটলিস্টে থাকা টার্গেটের পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। সুযোগমতো ব্যাগ থেকে ধারালো অস্ত্র বের করেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কখনো নির্জন স্থানে, কখনো প্রকাশ্যে জনসমক্ষে। খুন করেই মিশে যাচ্ছে মানুষের ভিড়ে। কোনো কোনো ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুনের দায়ও স্বীকার করছে ঘাতকচক্র। কিন্তু ভয়ঙ্কর এমন সিরিজ হত্যাকাণ্ডের পরও উগ্রপন্থি খুনিরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, দেড় বছরে উগ্রপন্থি ঘাতকচক্রের হাতে ১৪ জন নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে এক ঘটনাতেই ছয় খুনের ঘটনাও রয়েছে। ভিন্নমতাদর্শের ব্যক্তিদের হত্যার ধারাবাহিক মিশনের অংশ হিসেবেই উগ্রপন্থি ঘাতকচক্র এই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে পুলিশি তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের গ্রেফতার করতে পারছে না। এ অবস্থায় উগ্রপন্থিদের হিটলিস্টে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। তাদের লাশ ফেলতে সময় সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে উগ্রপন্থি ঘাতক চক্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, গোপীবাগের সিক্স মার্ডার, ব্লগার আশরাফুল ইসলাম, চ্যানেল আইয়ের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, উত্তরায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাশিদুল এবং মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ধরন একই। ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন এবং ব্লগার রাকিব মামুনের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে একই কায়দায়। সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের শিকার সবাই জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করে আসছিলেন। অধ্যাপক ইউনূস মৌলবাদবিরোধী শিক্ষক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, হুমায়ুন আজাদের মৌলবাদ বিরোধিতা তো সবারই জানা। আসিফের মতো রাজীব ও আশরাফুলও মৌলবাদবিরোধী লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন ব্লগে। অধ্যাপক শফিউল ছিলেন লালনভক্ত; আর বাউল দর্শনকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যায়িত করে বিভিন্ন সময়ে তাদের ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে জঙ্গিদের। গত বছর অক্টোবরে ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের শিকার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীও ছিলেন জঙ্গিবাদ বিরোধী। তার পরিবারের অভিযোগও জঙ্গিবাদীদের দিকে। এদের প্রত্যেককে হত্যার ঘটনায় ছোট অস্ত্রের পরিবর্তে খুনিচক্র ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন স্থানে এসব ব্যক্তি হামলার শিকার হলেও তাদের সবার ওপর হামলার ধরন ছিল একই। এসব হত্যাকাণ্ডে জেএমবি ও উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সম্পৃক্ততার বিষয় বারবার উঠে এসেছে। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড হয়েছে ডিসেম্বর অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, অভিজিৎ রায়ের মাথার ডান পাশে অত্যন্ত দক্ষ হাতে হিংস্রভাবে চাপাতির মতো কোনো ধারালো অস্ত্রের তিনটি কোপ দেওয়া হয়। ফলে আঘাতের প্রচণ্ডতা ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস হত্যা মামলায় দুই জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ। আদালতে চার্জশিটও দাখিল করা হয়। কিন্তু খুনের সঙ্গে জড়িতদের এখনো বিচার হয়নি। অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর রহস্য যেমন উদঘাটিত হয়নি, তেমনি ধরা পড়েনি ঘাতকচক্র। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে ফুটপাতে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ। পরে জার্মানিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্যরা। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. রুহুল আমিনের আদালতে বর্তমানে হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার বিচার চলছে। ইতিমধ্যে ৩৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস মৌলবাদবিরোধী শিক্ষক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে ফজরের নামাজ শেষে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুরে নিজের বাসার অদূরে পৌঁছালে ইউনুসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচারে দুই জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ছিলেন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। শাহবাগ আন্দোলন শুরুর ১০ দিনের মধ্যে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীতে বাসার সামনে তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি নর্থ সাউথের ছয় ছাত্রসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলাটির অভিযোগ গঠন হয়নি। রাজীব হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটে উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে দায়ী করা হয়েছে।
গোপীবাগের ৬ হত্যা : ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ৬৪/৬ আর কে মিশন রোডের ৪ তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার ভাড়া বাসায় ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় খুন হন কথিত ‘আধ্যাত্মিক পীর’ ইমাম মাহদীর সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুক ও তার বড় ছেলে সরোয়ার ইসলাম ফারুক। হত্যাকাণ্ডের শুরুতেই পুলিশের সন্দেহের চোখ ছিল জঙ্গিদের দিকে। এই সন্দেহের মধ্যেই এখনো ঘুরপাক খাচ্ছেন তারা। এ হত্যা মামলায় জেএমবির চার সদস্যকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তারা দায় স্বীকার করেনি। পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত ভিন্ন মতবাদ প্রচারের কারণেই বিপক্ষের কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের অগ্রগতি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
ফারুকী হত্যাকাণ্ড : গত বছরের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় বেসরকারি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। নিহতের স্বজনদের বক্তব্য, শরিয়ত ও সুফিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন মাওলানা ফারুকী। তাই বিভিন্ন সময়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। তার মতাদর্শ বিরোধীরাই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ তাদের। পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত ধর্মীয় মতাদর্শের কারণেই ফারুকীকে খুন করা হয়। সে অনুযায়ী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অবশ্য তারা বেশ কয়েকজন জঙ্গি এবং উগ্রপন্থি নেতাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কেউই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি।

সর্বশেষ খবর