বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

শাস্তির খড়গে বিরোধী মেয়র চেয়ারম্যানরা

শাস্তির খড়গে বিরোধী মেয়র চেয়ারম্যানরা

মামলা, গ্রেফতার ও বহিষ্কারের খড়গের নিচে পড়েছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের মেয়র-চেয়ারম্যানরাও। শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই নয়, তারাও এখন নানা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মামলার কারণে সিলেট, রাজশাহী, গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত সিটি মেয়রকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। অবশ্য এরই মধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একইভাবে দেশের উপজেলা, পৌরসভা, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকার বিভাগের বিরোধী জোটের জনপ্রতিনিধিদের ওপর শাস্তির খড়গ নেমে আসছে। অনেক জনপ্রতিনিধি গ্রেফতারের ভয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এলাকা ছাড়া। কেউ বা জেলে আছেন। আবার অনেককে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এ কারণে স্থবির তৃণমূলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। স্থানীয় সরকারের অধীনে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের। পৌরসভা আইন ২০০৯-এর ৩১ ও ৩২ ধারা অনুযায়ী পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে কোনো মামলার চার্জশিট হলে তাকে বরখাস্ত ও অপসারণ করা যাবে। বিরোধী দল সমর্থিত পৌর মেয়রদের বিরুদ্ধে ওই ধারা ব্যবহার করা হচ্ছে আইনি অস্ত্র হিসেবে। এদিকে উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ ২০০৯-এর ২৫, ২৬ ও ৪২ ধারা অনুযায়ী স্থানীয় এমপিকে উপজেলা চেয়ারম্যানদের মাথার ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে উপদেষ্টা হিসেবে। বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইউএনওদের। তাদের হাতের মুঠোয় বন্দী স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। এতে বিরোধী দল সমর্থিত চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা কাজের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বা বহিষ্কারের খড়গ নেমে এসেছে- তা স্মরণাতীত কালের রেকর্ড। অতীতে এমনটি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে এসব জনপ্রতিনিধিরা সত্যিকারে আইন লঙ্ঘন করেছেন কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। রাজনৈতিকভাবে হেয় করতে যদি এ ধরনের খড়গ নেমে আসে তাহলে তা হবে দুঃখজনক।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ‘যদি কোনো জনপ্রতিনিধি অন্যায় কাজ করে তাহলে অবশ্যই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের হামলা-মামলা কিংবা অন্য কোনো উপায়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তা হবে দুঃখজনক। তাহলে মানুষের আস্থা-বিশ্বাস বা ভরসাস্থল ভণ্ডুল হয়ে যাবে। এতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। যা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে তৃণমূলের জনগণ।’ জানা যায়, কারাগারে থাকা সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে গত জানুয়ারিতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলে থাকা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানের স্থলে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমানকে। নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার কারণে রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পলাতক রয়েছেন। মামলার হুলিয়া নিয়ে ঘুরছেন খুলনার মেয়র মো. মনিরুজ্জামান মনি। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মনজুর আলমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা না থাকলেও ভূমি দখলের মামলা রয়েছে। তবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল ইসলাম সাক্কুর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত আসামি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জিকে গউছ। তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে তারা দুজনই কারাগারে। সেক্ষেত্রে সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়র-২ অ্যাডভোকেট সালেহ আহমেদ। তিনি বিএনপি সমর্থিত। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল মেয়র-১ রেজাউল হাসান কয়েস লুদিও নিজেকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দাবি করছেন। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে নাগরিক সেবায় ব্যাঘাত ঘটছে। এ কারণে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী এনামুল হাবিবকে নতুন করে আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। জানা যায়, মামলা, বরখাস্ত কিংবা গ্রেফতার হওয়া মেয়র, চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানদের সবাই বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মণ্ডলকে ইতিমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া শিবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার ফাঁদে ধুনট উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম মামুন, বগুড়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আজগর তালুকদার হেনা ও সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল তৈয়ব জাকির পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে হরতাল-অবরোধে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ‘নাশকতা’ মামলা রয়েছে। গাইবান্ধার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল করীম, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাজেদুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান আবু সোলায়মান সরকার সাজু, পলাশবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান আবু কাউসার মো. নজরুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান আবু তালেব সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ পৌর মেয়র নূরুন্নবী প্রামাণিককেও বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১১টি নাশকতার মামলা রয়েছে। আগামী ৫ মার্চ ওই পৌরসভার উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তারা দুজনই উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। এ ছাড়া সম্প্রতি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ চাঁদকে বরখাস্ত করা হয়। গত ২০ অক্টোবর সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুর রউফকে শহরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ মাস্টার আদালতে একটি মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে আটক হন। তার বিরুদ্ধে দোকানপাট ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা দায়ের করে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কাছে শপথ নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিন উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান। তারা হলেন পঞ্চগড়ের আটোয়ারি উপজেলা চেয়্যারম্যান আবদুর রহমান আবদার, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, বোদা উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল আলম শফি, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী ও ভাইস চেয়ারম্যান আবদুর বাসেত সাজ্জান। পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের প্রতিবাদে যশোরে এক মানববন্ধনে হামলার ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের হয়। এতে যশোর পৌরসভা মেয়র মারুফুল ইসলাম, কেশবপুর পৌরসভার মেয়র আবদুস সামাদ বিশ্বাস, মনিরামপুর পৌরসভার মেয়র শহীদ ইকবাল, বাঘারপাড়া পৌরসভার মেয়র আবদুর রহিম মনা, কাউন্সিলর হাজী আনিসুর রহমান মুকুলসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এমনিতেই গণতন্ত্র আজ হুমকির মুখে। তার ওপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের শাস্তিস্বরূপ বরখাস্ত করাসহ গ্রেফতার-হয়রানিতে গণতন্ত্রের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছে। এটা সরকারের স্বেচ্ছাচারের মনোবৃত্তি।’

সর্বশেষ খবর