সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
আগুন ঝরা মার্চ

ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পেয়ে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করি

কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম

ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পেয়ে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করি

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা সর্বপ্রথম ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করি। ওই সময় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল ঝানঝুয়াসহ ক্যাপ্টেন আহমদ আলী, লে. আজম, লে. হুমায়ুন এবং বিডিআরের মেজর আবদুল হামিদ, ক্যাপ্টেন নজরসহ ছয়জন নিহত হন। নেভির অন্যান্য পদবির আরও ১০ জন এই বিদ্রোহে প্রাণ হারান। এই বিদ্রোহ ক্ষণিকের কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত বিদ্রোহের অংশ এবং এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করে অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই লোমহর্ষক। তখন আমি ছিলাম চট্টগ্রাম ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত কোয়ার্টার মাস্টার। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক লে. কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আমার ছিল ঘনিষ্ঠতা। এক সময় তিনি আমার অধিনায়ক ছিলেন। সেই সুবাদে ’৭০-এর নির্বাচনের আগে ও পরে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়শই আমরা আলাপ-আলোচনা করতাম। তার অজান্তে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও আমি এসব বিষয়ে আলোচনা করতাম। তারা একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন না। এমনকি মেজর জিয়ার সঙ্গেও আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। পাশাপাশি অফিস থাকায় ও কোয়ার্টার মাস্টার হওয়ার কারণে মেজর জিয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, পাকিস্তান আর্মির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে। একজন সেনাসদস্য হয়েও জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি, সবকিছুর ঊর্ধ্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ এবং জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেই। নিজের জীবনের কোনো গুরুত্ব ছিল না। এখানে বলে রাখা দরকার, ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন শুধু একটা রাজনৈতিক নির্বাচন ছিল না। সেই নির্বাচন ছিল কার্যত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে। তবে নিঃসন্দেহে এর ভিত রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর পাকিস্তানিদের গতিবিধি পর্যালোচনা করে আমাদের মনে হয়েছে, পাকিস্তানি জেনারেলরা শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে না। পাকিস্তানি জেনারেলদের এই মনোভাবের বিষয়টি এবং অভ্যন্তরীণভাবে আমাদের প্রস্তুতির বিষয়টি আমরা জেনারেল এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবহিত করি। আমাদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি জেনারেলরা আপনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে না। আপনার কাছে ক্ষমতাও হস্তান্তর করবে না। আমাদের যুক্তি ছিল দুটি। একটি হলো, যদি আপনি (শেখ মুজিব) প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে পাকিস্তানি জেনারেলদের হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা। আরেকটি হলো, ’৬৫-র যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নতুন কোনো দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে দেখিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর থেকে দেখছি নতুন নতুন সেনা দল আসছে। সুতরাং একটি বিষয় আমাদের কাছে খুবই পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে তারা শক্তি প্রয়োগ করে দেশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর এ জন্য তাদের সময় দরকার। তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে নেবে। আলোচনার টেবিলে রফাদফা না হলে তারা শক্তি প্রয়োগ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমন করবে। ১৮ মার্চ ১৯৭১ সাল, আমরা চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতা এম আর সিদ্দিকীর মাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুকে ভিতরে ভিতরে বাঙালি সৈনিকদের প্রস্তুতির কথা পুনরায় অবহিত করলাম। কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলে দিলেন, ‘না বাঙালি সেনাদের কোনো সাহায্য আমার প্রয়োজন নাই।’ বললেন, এক ইয়াহিয়া খানের পরিবর্তে আরেক ইয়াহিয়া খানকে চাই না। আমি যা-ই করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। উনি নিশ্চিত ছিলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। তাই ১৮ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সরাসরি বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেলে সকাল-বিকাল বৈঠক করে গেলেন। আমরা রাজনৈতিক নেতাদের চূড়ান্ত অবস্থান দেখার এবং অন্যদিকে বিদ্রোহ করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ আমরা নিশ্চিত ছিলাম, পাকিস্তানিদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই তারা ক্র্যাকডাউন করবে। তাই ভিতরে ভিতরে আমাদের পাল্টা প্রস্তুতি চলছিল। ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সশস্ত্র বিদ্রোহ করি। বিদ্রোহের পর মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমরা প্রথমেই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করি এবং ২৭ মার্চ বেতার থেকে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমি পাশে বসা ছিলাম। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। ওই বিদ্রোহে আমাদের নেতা ছিলেন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে এই বিদ্রোহের নেতৃত্বের দায়িত্ব বর্তায় তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। এ ঘোষণা দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত হওয়ার জন্য সব পক্ষকে বহুমাত্রিক প্রেরণা জোগায়, জনগণ দিকনির্দেশনা পায়। হতাশাগ্রস্ত জাতি আশ্বস্ত হয়। তার এই ঘোষণা জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যাপকভাবে উদ্ধুদ্ধ করে। ১৯৭১ সালে দেশের আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কথা বিবেচনায় ছিল না। বিবেচনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই সারা দেশের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করত। কিন্তু আজ সবকিছুই বিভক্তভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এখন এক মুক্তিযোদ্ধার অপর মুক্তিযোদ্ধার বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। অনুলিখন : আহমদ সেলিম রেজা

সর্বশেষ খবর