শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

সৌরবিদ্যুতে বদলে গেছে গ্রামীণ জীবন

সৌরবিদ্যুতে বদলে গেছে গ্রামীণ জীবন

একটা সময় সন্ধ্যার পর পরই যেখানে নেমে আসত ভুতুড়ে পরিবেশ- চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, এখন অন্যরকম পরিবেশ। সেখানে এখন 'আলোয় আলোকিত'। পদ্মা নদীবেষ্টিত ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর ও চরভদ্রাসন উপজেলার হরিরামপুর, ঝাউকান্দা, গাজীরটেক ইউনিয়নের গ্রাম। সৌরবিদ্যুতের আলোয় এখন আলোকিত পদ্মাপাড়ের এসব গ্রাম। সৌরবিদ্যুতের কারণে এখানকার মানুষের জীবনচিত্র পাল্টে গেছে। এদিকে এখন আর জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভর করতে হয় না। নেই কোনো লোডশেডিংয়ের বিভ্রান্তি। সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ কার্যক্রমে ঝিনাইদহের কৃষকদের মধ্যে জেগেছে ব্যাপক সাড়া। নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধার কারণে জমিতে বাম্পার ফলন ফলাচ্ছে কৃষকরা। আমাদের ফরিদপুর প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সোহেল জানান, একটা সময় সন্ধ্যার পর পরই যেখানে নেমে আসত ভুতুড়ে পরিবেশ- চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, এখন সেখানে বিরাজ করছে অন্যরকম পরিবেশ। সেখানে এখন 'আলোয় আলোকিত'। আর এটি সম্ভব হয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আমরা কাজ করি (একেকে)' বদৌলতে। সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর ও চরভদ্রাসন উপজেলার হরিরামপুর, ঝাউকান্দা, গাজীরটেক ইউনিয়নের গ্রামগুলোকে পাল্টে দিয়েছে সংস্থাটি। সৌরবিদ্যুতের আলোয় এখন আলোকিত এসব গ্রাম। সৌরবিদ্যুতের কারণে মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। এখন গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত। গ্রামের মহিলারা এখন রাতের বেলা 'আয়মূলক কাজ' করে সংসারের সচ্ছলতা আনতে ভূমিকা রাখছেন। ফলে দ্রুতই বদলে যাচ্ছে দুর্গম পদ্মাচরের দরিদ্র, অসহায় মানুষের জীবনচিত্র। নদীবেষ্টিত থাকায় এসব ইউনিয়ন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নৌকা, ট্রলারই একমাত্র মাধ্যম। ফলে মানুষ ছিল বেশ পিছিয়ে। স্কুল-কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে ছিল বঞ্চিত। এ ছাড়া বিদ্যুৎ পাওয়ার চিন্তা ছিল স্বপ্ন। সে স্বপ্ন এখন বাস্তব হিসাবে ধরা দিয়েছে। সৌরবিদ্যুতের আলোয় এখন আলোকিত পদ্মার দুর্গম চরের গ্রামগুলো। এসব ইউনিয়নের দুই হাজারের বেশি পরিবার সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা নিয়ে এখন আলোকিত। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের মোহন মিয়ার হাটে সন্ধ্যা নামতেই দোকানপাট বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা বাড়ি যেত। সেখানে সন্ধ্যার পর জমজমাট অবস্থা। মানুষ সারা দিন কাজ শেষে বাজারে এসে অনেক রাত পর্যন্ত সময় কাটান। এ গ্রামের মানুষ শহরের কিংবা দেশের খবর না রাখলেও এখন প্রতি রাতে বাজারগুলোতে জমজমাট আড্ডায় উঠে আসে রাজনীতি, খেলাসহ সব খবর। চলে নিরন্তর তর্ক-বিতর্কও। গ্রামের বাজার আলোকিত থাকায় বিকিকিনি বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক। অনেক অসহায় পরিবারের দিনবদলে গেছে। মহিলারা রাতে কাঁথা সেলাই, ঝুঁড়ি বানানো, মিষ্টির প্যাকেট বানানো, জামা-কাপড় সেলাইসহ নানা কাজ করে আয় করতে শুরু করেছে। ছেলেমেয়েরা গভীর রাত পর্যন্ত সুযোগ পাচ্ছে পড়ালেখার। সৌরবিদ্যুতে তেমন খরচ না থাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এটি। মোহন মিয়া হাটের চা দোকানদার কাসেম জানান, আগে সন্ধ্যা নামলেই দোকান বন্ধ হয়ে যেত। এখন অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। ফলে বিক্রি বেড়েছে অনেক বেশি। এখন সন্ধ্যার পরই লোক সমাগম বেশি হয়। স্থানীয় আলেপ মাতুব্বর জানান, আগে সন্ধ্যার পরই ঘুমিয়ে পড়তেন। এখন বাজারে আসেন। মাঝে-মধ্যে শাক-সবজি নিয়ে আসেন বিক্রি করতে। বিক্রি ভালোই হয় বলে জানান তিনি। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান মোস্তাক জানান, চরাঞ্চলের মানুষের কাছে বিদ্যুৎ ছিল কল্পনা। সৌরবিদ্যুতের কারণে এখন চরের গ্রামগুলো আলোকিত হয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আমরা কাজ করির (একেকে) ডেপুটি ডিরেক্টর বি এম আলাউদ্দিন জানান, জার্মানির সহযোগিতায় চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নের জন্য সোলার প্যানেল বসানোর কাজ হচ্ছে। ২০০৭ সাল থেকে দুই হাজারের বেশি সোলার প্যানেল দেওয়া হয়েছে। মাত্র তিন হাজার টাকায় সৌরবিদ্যুতের একটি ইউনিট দিয়ে দুটি পরিবারের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। নির্বাহী পরিচালক এম এ জলিল জানান, প্রতিটি সোলার প্যানেলের খরচ হয় ২৫/২৬ হাজার টাকা। জার্মানি দাতা সংস্থা আন্দ্রে-হিলফির সহযোগিতায় সাড়ে তিন হাজার টাকায় গ্রাহকদের সৌরবিদ্যুতের প্যানেলটি দিচ্ছেন। আমাদের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি শেখ রুহুল আমিন জানান, সৌরচালিত সেচ কার্যক্রমে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জেগেছে। এ পদ্ধতি অনেকটা ঝামেলামুক্ত। পাম্প চালাতে জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভর করতে হয় না। নেই কোনো লোডশেডিংয়ের বিভ্রান্তি। এ কার্যক্রম জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। মোটর কিংবা স্যালো মেশিনে সেচের থেকে অনেক কম খরচে ফসল উৎপাদন করা যাচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধার কারণে বাম্পার ফলন ফলাচ্ছে কৃষকরা। জানা গেছে, ২০১২ সালে পল্লী বিদু্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় জলবায়ু পরিবর্তন ও ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৪৩ লাখ ৯২ হাজার টাকায় প্রথমে কালীগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে সোলার প্লান্ট স্থাপন করা হয়। এতে প্রতিদিন দুই লাখ লিটার পানি উত্তোলনের ক্ষমতা রয়েছে। এর মাধ্যমে ৩০ বিঘা জমি সেচের আওতায় আনা হয়। এরপর সরকারের ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির (ইটকল) অর্থায়নে বেসরকারি এনজিও সংস্থা অ্যাকশন ইন ডেভেলপমেন্টের (এইডের) উদ্যোগে উপজেলার জামাল ইউনিয়নের হরদেবপুর গ্রামের মাঠে দুটি ও সদর উপজেলার পোড়াহাটি ইউনিয়নের চাপড়ি গ্রামের মাঠে দুটি সোলার ইরিগেশন পাম্প বসানো হয়েছে। একেকটি পাম্পের আওতায় ৩০ জন কৃষক ৫০ বিঘা জমিতে চাষ শুরু করেছেন। উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক আবু জাফর মুন্সী জানান, তার নিজের জমিতে সৌর প্লান্টের কারণে কৃষকদের খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। আগে মোটর ও স্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতেন। এ প্লান্টের আওতায় পার্শ্ববর্তী ১৫টি বাড়িতে আবাসিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে কৃষকরা প্রত্যেকের মাঠে প্লান্ট স্থাপনের কথা ভাবছেন। উপজেলার হরদেবপুর গ্রামের কৃষক সুজন বিশ্বাস জানান, এবার বাম্পার ফলনের আশা করছি। আরেক কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, ৩ ধরনের ফসলের উৎপাদন করা হচ্ছে এবং অনেক কম খরচে সেচ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কালীগঞ্জ পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির আবাসিক প্রকৌশলী তোফাজ্জেল হোসেন জানান, সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমিয়েছে। এইডের সৌরচালিত সেচ প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর চন্দন বসু মুক্ত জানান, ধান উৎপাদনে আগে স্যালো ও বিদ্যুৎচালিত মোটরে ৭/৮ হাজার টাকা খরচ হতো। এখন সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর