শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভুয়া এফডিআরে ব্যাংক ডাকাতি

হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, প্রতারক চক্রের সঙ্গে ব্যাংক কর্তারা জড়িত, মনিটরিংয়ের অভাব

ভুয়া এফডিআরে ব্যাংক ডাকাতি

এক ব্যাংকে ভুয়া ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট (এফডিআর) দেখিয়ে আর এক ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা মেরে দিচ্ছে জালিয়াত চক্র। এভাবে কয়েক বছরে ব্যাংক খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। এ যেন অবাধে ব্যাংক ডাকাতির মতো ব্যাপার। একের পর এক ঘটনা ঘটলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। এফডিআর সার্টিফিকেটের বিপরীতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না কর কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কোনো মনিটরিং নেই। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কোনো মনিটরিং নেই। জবাবদিহিতা না থাকায় জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের কোনো শাস্তি হয় না। ঋণ জালিয়াতির ঘটনা রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় খাতের ব্যাংকেই ঘটছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এফডিআরের বিপরীতে ঋণ দিতে বাধ্য করে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে যে কোনো ঋণ দেওয়ার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া আছে। এফডিআর সার্টিফিকেটের বিপরীতে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে এফডিআর ওনার ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। অতীতে কিছু ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রয়েছে। তবে আমাদের জনবল সংকট আছে। সব ঋণ খতিয়ে দেখা অনেক সময় কঠিন। এখন অবশ্য এসব জালিয়াতির ঘটনা কমেছে।’
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিমানা থেকে রেহাই পেতে এ ধরনের স্পর্শকাতর তথ্য গোপনও করছে। আর ভুয়া এফডিআরধারীদের বেশির ভাগই ঋণ নিয়ে গাঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে সংকটে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। টাকা উদ্ধার করতে পারছে না তারা। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সতর্কপত্র দেয়। তাদের আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। সরকারের অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষায় আইসিবি ইসলামী ও রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংক থেকে ২০০৯-২০১১ দুই বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিরীক্ষায় ধরা পড়েনি। তারা জানেই না এমন ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ৮ মার্চ ব্র্যাক ব্যাংকে কানাডাপ্রবাসী একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে এফডিআরের ৯০ কোটি টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় ১১ জনকে আটক করা হয়। জানা গেছে, এ ঘটনায় জড়িত আরও চার ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন সময় এফডিআরের ভুয়া কাজজপত্র তৈরি করে টাকা হাতিয়ে নেয়। এ চক্রটি জড়িত একটি সিন্ডিকেটে, যারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ভুয়া এফডিআর তৈরি করে ঋণ বরাদ্দ পাইয়ে দেওয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িত। জানা গেছে, এসব অনিয়ম-জালিয়াতিতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই নয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা জড়িত। তাদের যৌথ যোগসাজশে গড়ে ওঠা বিশাল চক্র ভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় জালিয়াতি করছে। অনেক সময় ব্যাংক নিজেই গোপন করার চেষ্টা করে। এদিকে শুধু ভুয়া এফডিআরই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির কারণে সাধারণ মানুষের জমানো হাজার হাজার কোটি টাকা অসাধু ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করছে। বন্ধকী সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা জাল সঞ্চয়পত্র ও ভুয়া এফডিআর বন্ধক রাখার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়েছে। ভুয়া দলিল, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কারণে পাঁচ বছর পর ওইসব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চার দশকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে। এ কারণে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে ১০ কোটি টাকার ভুয়া এফডিআর দেখিয়ে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে প্রতারক চক্রের হাত থেকে রক্ষা পায় বেসরকারি ব্যাংকটি। এ ধরনের আরও একাধিক অভিযোগ নিয়ে তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের অডিট অধিদফতরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জনতা, সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, রাকাব, আইসিবি ইসলামী, বেসিক ও বিডিবিএলে শতাধিক ঘটনা অডিট করে দেখা যায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে এফডিআর কাগজ নিয়ে ঋণ দেওয়া হয়েছে। যেসব কাগজ পুরোপুরি ভুয়া। বিলের বিপরীতে ঋণ নিয়ে ওই বিল আর ব্যাংক গ্রহণ না করে গ্রাহকের হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ব্যাংক কর্মকর্তারা উৎকোচের বিনিময়ে এ সুযোগ তৈরি করেন। ২০১৪ সালে উত্তরা ব্যাংকের নড়াইল শাখায় ৬০ লাখ টাকার এফডিআর জালিয়াতি হয়েছে। ওই ঘটনায় স্থানীয় এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের সহযোগিতায় এ টাকা হাতিয়ে নেন। পরে ব্যাংক ব্যবস্থাপক মো. শহিদুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয় ওই শাখা থেকে। ওই ঘটনায় দেখা যায়, খান কবির হোসেন নামে উত্তরা ব্যাংকে ৬ লাখ টাকার একটি এফডিআর খোলা হয়। এরপর ব্যবস্থাপক শহিদুর রহমানের যোগসাজশে ৬ লাখ টাকার এফডিআরের পরিবর্তে ৬০ লাখ টাকার এফডিআরের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেন এবং ৬০ লাখ টাকার বিপরীতে ৪৫ লাখ টাকার ঋণ বরাদ্দ করেন। গত বছর অভিনব একটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার এফডিআর নিয়ে। এসব এফডিআর সরকারি-বেসরকারি ৪০টি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে ছিল। ১০-১২ বছর ধরে এসব এফডিআর কিছু কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফার চেয়ে কম মুনাফায় টাকা জমা রেখে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। মুনাফার অতিরিক্ত টাকা সংশ্লিষ্টরা পে-স্লিপের মাধ্যমে তুলে নিয়ে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এতে প্রায় ১১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যাংক ও বন্দর কর্মকর্তা। এ ঘটনা দীর্ঘ সময় চলতে থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো তদন্ত বা অডিটে ধরা পড়েনি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক অডিটে ধরা পড়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর