বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

কার্যালয়ে খালেদার তিন মাস

কার্যালয়ে খালেদার তিন মাস

ঠিক তিন মাস পূর্ণ হলো আজ। একটি মাত্র কক্ষের মধ্যেই জীবনযাপন। ঘুম, বিশ্রাম আর হাঁটাচলা থেকে শুরু করে সবকিছুই একটি ভবনে। রাত-দিনের ২৪ ঘণ্টাই কাটে এখানে। এর মধ্যেই চলে কার্যালয়ে অবস্থানকারী দু-এক জন নেতা-নেত্রী বা আগত অতিথিদের সঙ্গে কথাবার্তা। দীর্ঘ ৯০ দিন ধরে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৩ জানুয়ারি ‘অবরুদ্ধ’ হওয়ার পর কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষই মূলত তার ঠিকানা। মাঝেমধ্যে পাশের স্থায়ী কমিটির সভাকক্ষটিতে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, দলীয় নেতা কিংবা কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। এ দুটি রুমের বাইরে প্রকৃতির আলো-বাতাসও চোখে পড়ে না তার। তার মধ্যেও এখন মাথার ওপরে ঝুলছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, বিগত তিনটি মাসের মধ্যে মাত্র চারবার নিচে নেমেছেন তিনবারের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থায় ৫ জানুয়ারি কার্যালয়ের মূল ফটকের সামনে এসে পুলিশি বাধা পেয়ে সেখান থেকেই সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে ২৬ জানুয়ারি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা হলে নিচ তলায় নেমে আসেন বিএনপির এই নেত্রী। এ ছাড়াও দুই দিন নিচে নেমেছেন দুটি সংবাদ সম্মেলন করার জন্য। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, দলীয় কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয়সহ বিভিন্ন ধরনের বই-পুস্তক আর পত্রিকা পড়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে খালেদা জিয়ার। ইন্টারনেট কানেকশন ও ডিস লাইন বিচ্ছিন্ন থাকায় আন্তর্জাতিক খবরাখবর জানা কিংবা টেলিভিশনের সংবাদ দেখতে না পেলেও নির্ধারিত সময়ে বিবিসিসহ অন্যান্য রেডিওর খবর নিয়মিত শোনেন তিনি। এ ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি দলীয় নেতা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলেও সময় কাটে তার। মামলা-হামলার কারণে বাইরে থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা তেমন একটা কার্যালয়ে যেতে না পারলেও দলীয় ঘরানার বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী নেতা এখন দু-এক দিন পরপরই যাচ্ছেন তার সঙ্গে দেখা করতে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা নিয়মিত এসে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পায়ের গোড়ালির সমস্যা, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগের প্রতিনিয়ত চেকআপ করেন তার। মাঝেমধ্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও এসে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়ে যান। তবে এখন তার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। নামাজ-কালামসহ অজিফা পাঠ, ইবাদত-বন্দেগি করে, ধর্মীয়সহ বিভিন্ন বই আর পত্রপত্রিকা পড়ে সময় কাটান তিনি। তবে প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর থেকে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত কার্যালয়ে আগত অতিথি ও আত্মীয়স্বজনদের পাশাপাশি দলীয় নেতা এবং কার্যালয়ে অবস্থানকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেই সময় কাটান তিনি। এ পরিস্থিতিতে কেমন আছেন তিনি- জানতে চাইলে অফিসে অবস্থানকারী একজন নেতা বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ৯০ দিন ধরে কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ থাকলে একজন নেত্রী কতটা ভালো থাকতে পারেন, এটা সবারই জানা।
গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ সম্পর্কে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সুবিধা-অসুবিধা বিসর্জন দিয়ে শুধু গণতন্ত্র, দেশ আর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এরকম কষ্টকর জীবন বেছে নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের ঘটনা নজিরবিহীন। এটা তো লুকানো-ছাপানোর কিছু নেই যে, তিনটি মাস ধরে তার ওপর দিয়ে কত রকমের ঝড়-ঝাপ্টা অতিবাহিত হয়েছে। কার্যালয়ের ভিতরে তাকে লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে মারা থেকে শুরু করে খাবার পর্যন্তও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের লাইন ও ইন্টারনেট কানেকশন, ডিসলাইনসহ টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে সারা দেশবাসী অবগত। এমনকি মোবাইল ফোনের লাইন পর্যন্তও কেটে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তার ছোট ছেলে পর্যন্তও মারা গেছেন। নেত্রীর নামে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও কার্যালয় তল্লাশির ‘সার্চ-ওয়ারেন্ট’। দেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। তার পরও তিনি দেশ ও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পিছপা হননি, রয়েছেন অনড়, অবিচল। শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেও তিনি জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
তবে কার্যালয়ে অবস্থানকারী দলের অন্য একজন সিনিয়র নেতা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসায় অবস্থান আর গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সরকারের অঘোষিত ‘গৃহবন্দী’ অবস্থার মাঝে বরং বাসার চেয়ে কার্যালয়েই তিনি অধিক স্বস্তি অনুভব করেন। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগেও তাকে গুলশানের বাসায় আটকে রাখা হয়েছিল। তখন কারও সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ পর্যন্তও ছিল না। কারও সঙ্গে কোনো কথাবার্তা পর্যন্তও বলতে পারেননি। তা ছাড়া দু-এক জন কাজের লোক ছাড়া তার কোনো আত্মীয়স্বজনও বাসায় থাকেন না। সে হিসেবে তিনি তার গুলশান কার্যালয়ে অনেকটা স্বস্তিতেই আছেন।
জানা যায়, গত মার্চের বেশির ভাগ সময়ই ছিল গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য অনেকটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আদালতে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতা-নেত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন। অস্বস্তির এ পর্যায়ে গ্রেফতার হওয়ার জন্য তারা মানসিকভাবে এক ধরনের তৈরিই ছিলেন। দিনভর নাওয়া-খাওয়া পর্যন্তও বন্ধ ছিল। পরে পর্যায়ক্রমে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। নজরুল ইসলাম খান আরও জানান, শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও চলমান আন্দোলনের সফলতা নিয়ে চরম আশাবাদী বেগম জিয়া। নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের গণদাবিতে নিজের অবস্থানে এখনো অনড় তিনি। এদিকে হরতাল-অবরোধের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালালেও বিকল্প কর্মসূচিরও চিন্তাভাবনা করছেন বিএনপি-প্রধান। ইতিমধ্যে সিটি নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটিকে হরতালের আওতামুক্ত করাসহ সারা দেশেও হরতালের পরিমাণ কমানো হয়েছে। হরতালের পরিবর্তে সারা দেশে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে অধিক হারে।
কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, নিজের বাসার পাশাপাশি বড় ছেলে তারেক রহমানের শ্বশুরবাড়িসহ দুই ভাইয়ের বাসা থেকে প্রতিদিন খাবার আসে বেগম জিয়ার জন্য। দুই ভাই সাঈদ এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দারের পরিবার ছাড়াও সেজ বোন সেলিনা ইসলামের বাসা থেকেও খাবার পাঠানো হয়। তবে স্বল্পাহারী খালেদা জিয়া সামান্য ভাত ও সবজি, সঙ্গে এক টুকরা মাছ বা এক টুকরা মাংস দিয়েই সাধারণত তার খাবার সারেন। সবজির মধ্যে করলা ভাজিটা একটু বেশি পছন্দ করেন তিনি। এ ছাড়া তাজা ফলমূলের মধ্যে পেঁপের জুসটা বেশি ভালোবাসেন প্রবীণ এই রাজনীতিক।
কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত রাত ৯টা-১০টার মধ্যেই ইশার নামাজ পড়ে নিলেও রাতে প্রায় প্রতিদিনই দেরিতে ঘুমাতে যান বিএনপি নেত্রী। সকালের নাশতা ও চা খেয়ে তিনি কিছুক্ষণ পত্রপত্রিকায় চোখ বোলান। অতঃপর একটু বিশ্রাম নিয়ে দলীয় কাজকর্মের দিকে মনোনিবেশ করেন। সন্ধ্যার পর গুলশানে অবস্থানকারী বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বা বেগম সেলিমা রহমানসহ অন্য কোনো নেতা কার্যালয়ের কর্মকর্তা কিংবা নিজের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়াও ৩ জানুয়ারি রাত থেকে গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবস্থান করছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ কয়েকজন কর্মকর্তা।
১১ ফেব্রুয়ারি ১৬টি দেশের কূটনীতিকদের সাক্ষাৎ উপলক্ষে গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশের পর থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এখনো অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি সারা দেশে দলের সার্বিক বিষয় তদারক করছেন। চেয়ারপারসনের পক্ষে জেলা-মহানগরসহ বিভিন্ন স্তরের নেতার সঙ্গে ফোনালাপের মাধ্যমে আন্দোলন সমন্বয় করছেন। কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ ছাড়া সব মিলিয়ে নেতা-নেত্রীসহ খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমানে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। তাদের সঙ্গে নিয়েই আজ তিনটি মাস অতিক্রম করলেন ২০-দলীয় জোট নেত্রী।

সর্বশেষ খবর