সোমবার, ২৫ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কেন এই যাত্রা

মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কেন এই যাত্রা

মিয়ানমারের মতো জাতিগত সংঘাত না থাকার পরও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ জীবনমান উন্নয়নের উচ্চাকাক্সক্ষা। বাংলাদেশিদের এই মরণ যাত্রায় মেতে ওঠার আরও অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, সচেতনতার অভাব, বিদেশ যাত্রার উপায় সম্পর্কে বিভ্রান্তি, দালাল ও পাচারকারীদের তৎপরতা, পাচারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা, তদারকি কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার অভাব মানব পাচারে বিপুল অবৈধ অর্থের হাতছানি এবং ইতিমধ্যেই মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে স্বজনদের প্ররোচিত হওয়া ও বৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ সংকুচিত হওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মানব পাচার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে ও বিভিন্নভাবে টেকনাফ দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিতদের বেশিরভাগই দালালদের অগ্রিম টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়া যাবে এমন তথ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। আবার অনেক হতদরিদ্র মানব পাচারের শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে টাকা পরিশোধের শর্তে। তবে বাংলাদেশি এই পাচার হওয়াদের বেশিরভাগই মধ্য পথে গিয়ে মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে আটকে রেখে বাংলাদেশে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। সমীক্ষা অনুসারে, সাগরপথের অবৈধ রুট চালুর পর থেকে বাংলাদেশিদের পাচার হওয়ার সংখ্যা কম ছিল। সে সময় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছিল সাগরপথের মূল যাত্রী। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকেই বাংলাদেশিদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। ২০১৩ সালে এসে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিবিসির প্রতিবেদনের তথ্য, রোহিঙ্গাদের আটকে রেখে টাকা-পয়সা পাওয়া যায় না, কিন্তু বাংলাদেশের বিদেশ গমনেচ্ছুদের আটকে মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব হয়। এ কারণে বাংলাদেশিদের পাচারে বিশেষ আগ্রহ পাচারচক্রের। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৫ হাজার মানুষ সাগরপথে দেশ ছেড়েছেন। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দামান সাগরে আটকে পড়া অবৈধ অভিবাসীদের অর্ধেকই বাংলাদেশি। তারা শুধু নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছেন। সে হিসেবে অবৈধ পথে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পরিবারের সচ্ছলতা আনতেই বেশির ভাগ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। ভালো জীবনের ফাঁদে পা দেওয়া সহজ-সরল মানুষগুলো টেরই পাচ্ছেন না যে তারা ভয়াবহ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছেন। কিন্তু এ জন্য শুধু পাচারকারী ও পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালী এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সদস্যরা কাজ করছেন তাদের কার্যক্রমও সন্দেহজনক। বিভিন্ন জেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই পাচারকাজে জড়িত আছেন বলে সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন। পাচার রোধে কাজ করা জেলাপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্রে টহল দেওয়ার জন্য তাদের বোট-ট্রলার নেই। কিছু ক্ষেত্রে তারা স্থানীয়দের ট্রলার ভাড়া নিয়ে অভিযান চালান। আবার স্থানীয়দের অনেকেই আছেন যারা পাচারের সময় ট্রলার ব্যবহার করছেন। এ জন্য ট্রলার কেনার সময় এবং জেলে হিসেবে লাইন্সেস করা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে পাচার রোধে টহল বা অভিযান পরিচালনার সময় সংশ্লিষ্টদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। এর ফলে পুলিশ এসব জায়গায় গেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের পাচার হওয়া এবং বাংলাদেশিদের পাচার হওয়ার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। রোহিঙ্গারা কোনো দেশের নাগরিক নয়। তারা চরম কোণঠাসা হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার প্রায়ই বলে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে দেশের নাগরিকরা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে, তা ওই দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটিং মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, আমরা সব সময় বলে এসেছি, বৈধপথে অভিবাসন কমে গেলে অবৈধপথে অভিবাসন বেড়ে যায়। আমি স্পষ্ট বলতে চাই, মালয়েশিয়ায় জি টু জি নিয়ে সরকার যে প্রত্যাশা মানুষকে দেখিয়েছিল সে অনুযায়ী যদি কর্মী পাঠাতে পারত তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যেত। যেহেতু মানব পাচারের ঘটনা মালয়েশিয়াকেন্দ্রিকই বেশি, সেহেতু এ মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে জি টু জি বাতিল করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রেখে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লোক পাঠানো উচিত। কারণ কেউ বিপদে পড়লে তাদের কমপক্ষে লাগাম টেনে ধরা যাবে। রিক্রুটিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশারের মতে, সমুদ্রে বা থাইল্যান্ডের বন-জঙ্গলে যাদের পাওয়া যাচ্ছে তারা সবাই একদিনে যায়নি। কিংবা শুধু মালয়েশিয়ার উদ্দেশেই যায়নি। দালালচক্র ভালো বেতনের কথা বলে অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকদের নিয়ে সমুদ্রে বা উপকূলে জড়ো করে তাদের পরিবারের কাছে বড় অঙ্কের মুক্তিপণের টাকা দাবি করছে। এ চক্র দেশের সুনাম নষ্ট করছে। যেখানে বিমানে বা অন্যভাবে একটা অবৈধ লোকও বিদেশে যেতে পারে না সেখানে সাগরপথে হাজার হাজার মানুষ কীভাবে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ অবশ্যই জড়িত আছে। তাদের সহযোগিতায় পাচারচক্র এ সব অপকর্ম করে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর