মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সিরিয়াফেরত নারী

পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সিরিয়াফেরত নারী

মাদকাসক্ত স্বামীর কাছে দিনের পর দিন নির্যাতন। সঙ্গে আর্থিক টানাপড়েন। দুই সন্তানসহ মাসের অন্তত ১৫ দিনই এক বেলা খেয়ে দিন কাটে। লেবাননে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনের প্রলোভন। তাই একদিন সুখের আশায় প্রতিবেশী এক দালালের ফাঁদে পড়ে স্বামী-সন্তান দেশে রেখে লেবাননে পাড়ি জমান ফারহানা আক্তার (ছদ্মনাম)। ভেবেছিলেন এবার অন্তত দুই বেলা খাবার নিশ্চিত হবে। তবে সুখ তার কপালে সয়নি। পাসপোর্টে লেবাননের ভিসা থাকলেও প্রতারক চক্র কৌশলে তাকে পাঠিয়ে দেয় সিরিয়ায়। ঠাঁই হয় একটি নির্যাতন ক্যাম্পে। দালালদের কথামতো কাজ করতে রাজি না হওয়ায় টানা ছয় মাস চলে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন। দুই দফা লুকিয়ে নির্যাতন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তবে প্রতিবারই সিরিয়ার পুলিশ তাকে তুলে দেয় দালালদের হাতে। তবু থেমে থাকেনি নির্যাতন। এক পর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ ফারহানাকে (২৮) দিয়ে কোনো কাজ করানো সম্ভব না হওয়ায় গত জানুয়ারিতে দেশে ফেরত পাঠায় দালাল চক্র। সর্বশেষ রবিবার ফারহানার মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব পল্টন এলাকা থেকে দালাল চক্রের দুই হোতা জসিম আহমেদ ও সিরাজ শিকদারসহ ১৩ সদস্যকে আটক করে। পরে র‌্যাব-৩-এর কার্যালয়েই কথা হয় ফারহানার সঙ্গে। নির্যাতনের কাহিনী শুনে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ফারহানা এ প্রতিবেদককে বলেন, “আমি অন্ধকার যুগে ছিলাম। আমাকে দিয়ে করানো হতো পতিতাবৃত্তি। রাজি না হলেই চলত রাত-দিন নির্যাতন, তিন বেলার বদলে জুটত এক বেলা খাবার, ছোট্ট একটি কক্ষে গাদাগাদি করে ৩০-৩৫ জন থাকা। এর মধ্যে ২৮ জনই বাংলাদেশি। দালালদের প্রস্তাবে রাজি না হলেই ইলেকট্রিক শক দিত। নির্যাতনের এক পর্যায়ে একদিন আমার হাতও ভেঙে দেওয়া হয়। চিৎকার করলেই মুখে গুঁজে দেওয়া হতো কাপড়। কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ফেলে রাখা হয় আমাকে। সর্বশেষ আমাকে দিয়ে ‘কোনো কাজ’ হবে না বলেই তারা দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।” এটুকু বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন ফারহানা। 

ফারহানার পাশেই বসা ছিলেন তার মা হাফিজা বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘সিরিয়া থেকে নভেম্বর মাসে ফারহানা আমাকে লুকিয়ে ফোন করে। শুরুতেই বলে মা আমাকে বাঁচাও। আমি মারা যাচ্ছি। দুই মিনিট কথা হইতেই লাইন কেটে যায়। পরে পল্টন থানায় দিনের পর দিন ঘুরছি। তারা একদিন দালাল সিরাজ শিকদারকে ডাকে। তবে আমার কোনো কথা তারা শোনেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার অসুস্থ মেয়ে দেশে ফেরার পর কয়েক দফায় ৯০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ওর চিকিৎসা করিয়েছি। এর পরও সুস্থ হয়নি। ডাক্তার বলেছে, দিনের পর দিন খাবার-পানি না খাওয়ার কারণে তার কিডনিতে সমস্যা হয়েছে। এখন আমরা কোথায় যাব বলেন বাবা?’   

নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফারহানা জানান, দালাল সিরাজ তাকে কাতার কিংবা লেবাননে পাঠানোর কথা বলেন। খরচ হবে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন। থাকা-খাওয়া ফ্রি। সিরাজের কথায় রাজি হয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে তার হাতে তুলে দেন। সঙ্গে দেন ৫০ হাজার টাকাও। গত বছরের প্রথম দিকে সিরাজ তাকে কাতারে পাঠান। কাতার গিয়ে এক বাসায় কাজও শুরু করেন। কিন্তু বাসার পুরুষ মানুষ তাকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করেন। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে দালালকে জানান তিনি। দালাল সিরাজ তাকে বুদ্ধি দেন বাসা থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়ার জন্য। বলেন, ফিরে এলে তাকে বিনা খরচে লেবাননে পাঠাবেন। সেখানে এমন কোনো সমস্যা হবে না। ফারহানা তা-ই করেন। রাস্তা থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। পনের দিন থাকতে হয় কারাগারে। পরে দূতাবাসের মাধ্যমে ফিরে আসেন দেশে। এরপর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর আরও ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালাল তাকে লেবাননে পাঠানোর জন্য তুলে দেন বিমানে। কিন্তু দুবাই থেকে দালালরা তাকে নিয়ে যায় সিরিয়ায়। এরপর তিনি গিয়ে পড়েন আরেক নরকে। ফারহানা বলেন, কীসের গৃহকর্মীর কাজ, তাকে পাঠানো হয়েছে পতিতা হিসেবে কাজ করার জন্য। এটা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। দালালরা তাকেসহ ২৮ জন বাঙালি নারীকে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে একটি ঘরে আটকিয়ে রাখে। প্রতিদিন একজন করে এসে গৃহকর্মীর কাজ করানোর কথা বলে বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু বাসায় নিয়েই শুরু করে যৌন নির্যাতন। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কখনো পেরে উঠতেন, কখনো না। এ কারণে দু-এক দিন পরই সেই লোক তাকে আবার ফেরত দিয়ে যেতেন দালালদের সেই অফিসে। বাধা দেওয়ার কারণে অফিসে চলত নির্যাতন। হাত-পায়ের তালুতে পেটানো হতো। দেওয়া হয়েছে ইলেকট্রিক শকও। ফারহানা বলেন, দালালদের কথামতো কাজ না করায় খাবার দেওয়া হতো এক বেলা, প্রতিদিন বিকালে। তাই খেয়ে কোনোরকমে দিন পার করতেন তিনি। বাড়িতে যোগাযোগেরও কোনো উপায় ছিল না। অচেনা জায়গা, কোথায় গিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। দুবার পালিয়েছিলেন, পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু পুলিশও আবার তাকে দালালদের সেই অফিসে রেখে গেছে। ফারহানার ভাষ্য, একটি বাসায় তিনি দিন পনেরোর মতো ছিলেন। ওই বাসার গৃহকর্তা ও তার ছেলে দুজনই তাকে ধর্ষণ করেছেন। আরেক বাসায় ছিলেন দিন দশেক। সেই বাসার গৃহকর্তা ভালো ছিলেন। কিন্তু গৃহকর্তার বৃদ্ধ বাপ তাকে যৌন নির্যাতন করতেন। বিষয়টি গৃহকর্তা ও তার স্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারা তার কথাকে পাত্তাই দেননি। বৃদ্ধকে যৌন নির্যাতনে বাধা দেওয়ায় তাকে আবারও পাঠানো হয় দালালদের সেই অফিসে। সেবার নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় আরও। পিটিয়ে হাত ভেঙে ফেলা হয় তার। এ সময় পুরোটাই অফিসে পড়ে থাকেন তিনি। একদিন ইন্দোনেশীয় এক তরুণীর মোবাইল নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ফোন করেন মাকে।

সর্বশেষ খবর