শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা
বিএনপি

নেতা জেলার, বছরজুড়েই থাকেন ঢাকায়

নেতা জেলার, বছরজুড়েই থাকেন ঢাকায়

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সভাপতিও তিনি। বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড- সবকিছুতেই জেলায় তার অনুপস্থিতি। সারা বছরই ঢাকায় আইন পেশায় ব্যস্ত সময় কাটান তিনি। রমজানে গিয়েছিলেন এক ইফতার পার্টিতে। ওই অনুষ্ঠানেও নেতা-কর্মীদের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বলে জানা গেছে। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তিনি আবার বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানও। সারা বছর জেলার কোনো কর্মকাণ্ডে নেতা-কর্মীরা পান না সাবেক এই আমলাকে। কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি তাসভীরুল ইসলাম। সারা বছরই থাকেন ঢাকায়। হঠাৎ করে রমজানে জেলায় গিয়েছিলেন এক ইফতার পার্টিতে। সেখানে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জানা যায়, বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে ওই তিন শীর্ষ নেতার যেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, সাংগঠনিকভাবেও নিষ্ক্রিয় ছিল ওইসব জেলা। সম্প্রতি দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের নিজ নিজ জেলায় যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মাঠের নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নেন। জনগণের পাশে দাঁড়ান। আন্দোলনে থাকা নেতাদের এবার কমিটিতে উপযুক্ত জায়গা দেওয়া হবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক ইউনিটের বেশির ভাগেরই চালচিত্র প্রায় একই রকম। কোনো কোনো জেলার শীর্ষ নেতারা এলাকায় থাকলেও বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করে নিজেদের আড়াল করে রাখেন তারা। এসব নেতার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাও কম। সব ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের। গ্রেফতারের হুলিয়া ও মামলা-হামলায় জর্জরিত এসব কর্মী-সমর্থকদের পাশেও দাঁড়াননি জেলার সুবিধাভোগী নেতারা। মাঠের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বিগত আন্দোলনে কিছু জেলায় কিংবা মহানগর পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত মিছিল-সমাবেশ হলেও তা ছিল অনেকটাই লোকদেখানো। গণমাধ্যমে ছবি কিংবা প্রতিবেদন আসার পরপরই ওইসব জেলা নেতাদের আর এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর ফলে পুলিশি শাস্তির খড়গ নেমে আসে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ওপর। বিএনপিতে ২০ হাজারের অধিক মামলায় ৫ লাখ আসামির অধিকাংশই তৃণমূলের নেতা-কর্মী। কেন্দ্র থেকেও তারা পাচ্ছে না পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা। এরই মধ্যে অনেকে গ্রেফতার, গুম, খুনের শিকার হওয়ায় তাদের পরিবার-সংসারও ভেঙে গেছে। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দাবি, দমনপীড়ন ও ত্যাগ-তিতিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই জেলা ও কেন্দ্র নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে নীতিনির্ধারকদের। ইতিপূর্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যারা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিলেন তাদের বাদ দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতের আন্দোলনেও একই ফল আসবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। সুতরাং নেতৃত্ব নির্বাচন করতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। তারা আশা করছেন, সামনে দল পুনর্গঠনে তৃণমূল নেতাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে। বিগত আন্দোলনে জেলা নেতাদের ভূমিকা কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে কোন কোন নেতা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তা নিয়েও আলোচনা করা হয়। প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিষয়গুলো ওই চিত্রেরই অংশবিশেষ। খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া। বছরের বেশির ভাগ সময়ই তাকে ঢাকায় দেখা যায়। অবশ্য মাঝেমধ্যে মামলার হাজিরা দিতে যান খাগড়াছড়ি। জেলা সংগঠনও নিষ্ক্রিয়। ফরিদপুর জেলার নেতৃত্বে শাহজাদা মিয়া ও সৈয়দ মোদারেছ আলী ঈশা। শাহজাদা মিয়া বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকেন। ঈশা ফরিদপুরে থাকলেও আন্দোলন-সংগঠনে নিষ্ক্রিয়। শরীয়তপুরের শফিকুর রহমান কিরণও আন্দোলনে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। রাজবাড়ী জেলার নেতৃত্বে আলী নেওয়াজ খৈয়াম ও অ্যাডভোকেট হারুন অর রশীদ। সর্বশেষ আন্দোলনে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। মানিকগঞ্জে রীতা-শান্তর কমিটিকেও আন্দোলনের মাঠে দেখা যায়নি। নেত্রকোনায় আশরাফ আলী আন্দোলন ও সংগঠনে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়।  ময়মনসিংহ দক্ষিণের সভাপতি এ কে এম মোশাররফ বছরের বেশির ভাগ সময় থাকেন ঢাকায়। সেখানে ছাত্রদল, যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দলসহ স্থানীয় বিএনপিই আন্দোলনে কমবেশি ভূমিকা রাখছে। ময়মনসিংহ উত্তরের শীর্ষ নেতা খুররম চৌধুরীও ছিলেন নিষ্ক্রিয়। শেরপুরের মাহবুবুল হক রুবেল বেশির ভাগ সময়ই ঢাকায় অবস্থান করেন। রংপুরে সাইফুল ইসলাম ও এমদাদ ভরসার কমিটিও গত আন্দোলনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। জয়পুরহাট জেলা সেক্রেটারি ফজলুর রহমানেরও এলাকায় যাওয়া হয় কালেভদ্রে। আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় রাজশাহী জেলা বিএনপিও। নড়াইল জেলার শীর্ষ নেতা বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলমের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। মাগুরা জেলা বিএনপির সেক্রেটারি আলী আহমেদকেও নেতা-কর্মীরা কাছে পান না। চুয়াডাঙ্গার শীর্ষ নেতা ওয়াহিদুল বিশ্বাস বিএনপির কার্যালয়ের সাইনবোর্ড নামিয়ে মাঠছাড়া হয়ে আছেন। আন্দোলনে ঢাকায় অবস্থান করেন নীলফামারী জেলা নেতা শামসুজ্জামান জামান। সৈয়দপুরের আমজাদ হোসেন ভাজও ছিলেন নিষ্ক্রিয়। লালমনিরহাট জেলার সভাপতি আসাদুল হাবিব দুলুকেও সর্বশেষ আন্দোলনে মাঠে পায়নি নেতা-কর্মীরা।  ভোলা জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীর। এলাকায় থাকলেও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় তিনি। সংগঠনও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পুরো বরিশাল বিভাগ বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে বরাবরই পিছিয়ে। সাংগঠনিকভাবেও অগোছালো এ বিভাগটি। বিএনপির আন্দোলনের বিচারে বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল মহানগর, বরিশাল দক্ষিণ, বরিশাল উত্তর, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের ফলাফল শূন্য। আগামী দিনে এ বিভাগে সংগঠনের নেতৃত্বেও আমূল পরিবর্তন আসবে বলে জানা গেছে। আন্দোলনে নেতা-কর্মীরা মাঠে পাননি খুলনা জেলা বিএনপির সেক্রেটারি শফিকুল আলম মনা ও খুলনা মহানগর সেক্রেটারি মনিরুজ্জামান মনিকেও। বাগেরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বাবুও ছিলেন মাঠছাড়া। গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনকেও আন্দোলনে খুঁজে পায়নি নেতা-কর্মীরা। কিশোরগঞ্জ বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানও রাষ্ট্রদ্রোহসহ মামলার কারণে এলাকাছাড়া। চট্টগ্রাম উত্তরের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বছরের বেশির ভাগ সময়ই ঢাকায় থাকেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণের সেক্রেটারি গাজী শাহজাহান জুয়েলও আন্দোলনের মাঠে নিষ্ক্রিয়। হবিগঞ্জের এস এম ফয়সাল, সিলেটের অ্যাডভোকেট নূরুল হক, মৌলভীবাজারের এম নাছের রহমানকেও আন্দোলনে দেখা পায়নি মাঠের নেতা-কর্মীরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে বিগত আন্দোলনে কারা সক্রিয় ছিলেন সেই বিচারে। সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও যোগ্য তরুণ নেতৃত্বই বিএনপির সব কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবে। নিষ্ক্রিয় নেতাদের ক্ষেত্রে বিএনপি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তবে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘দল পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। সেখানে অবশ্যই যোগ্যরা অগ্রাধিকার পাবেন।’

সর্বশেষ খবর