বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

নিষ্ক্রিয় হলেও বড় দায়িত্ব নিয়ে আছেন বিএনপির বয়স্ক নেতারা

নিষ্ক্রিয় হলেও বড় দায়িত্ব নিয়ে আছেন বিএনপির বয়স্ক নেতারা

বয়সের ভারে ন্যুব্জ বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। রাজনীতিতেও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় তারা। অসুখে-বিসুখে হাসপাতালে কিংবা বাসাতেই দিন কাটে তাদের। এক সময় বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থাকলেও এখন তাদের বার্ধক্য পিছু ছাড়ছে না। নেতা-কর্মীদের থেকেও অনেকটা দূরে অবস্থান করছেন তারা। দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা এখন রাজনীতিতে পুরোপুরি ‘অক্ষম’। যদিও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, শিক্ষা-দীক্ষাসহ নানা গুণে বলীয়ান এসব নেতা। কিন্তু শরীর-মন কোনোটাই টানে না তাদের। বিএনপির আগামী দিনের নেতৃত্বে এসব নেতার জন্য একটি সম্মানজনক বিদায় কিংবা সুবিধাজনক পদে মূল্যায়িত করে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা চলছে। সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এমনটাই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘আন্দোলনে থাকা ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের সামনে নিয়ে আসা হবে। সেক্ষেত্রে যারা অসুস্থ ও বয়স্ক, তাদেরকেও একটু ছাড় দিতে হবে।’   

জানা যায়, বয়স্ক ও অসুস্থ এই নেতাদের ‘সিনিয়র উপদেষ্টা’ পদ সৃষ্টি করে সেখানে পদায়ন করা হতে পারে। এক্ষেত্রে দলের গঠনতন্ত্রও সংশোধন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ রাজনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি, এম শামসুল ইসলাম, বেগম সারওয়ারী রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান বিচারপতি টি এইচ খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুন অর রশীদ মুন্নু, নূরুল ইসলাম দাদু প্রমুখ। দলের কর্মসূচিতে তাদের খুব একটা পাওয়া যায় না। পারিবারিকভাবেই সময় কাটে এক সময়ের প্রভাবশালী এই নেতাদের। এ ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, এম কে আনোয়ার, এম মোর্শেদ খান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বেগম রাবেয়া চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, মুশফিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের বয়স ৭৫ এর কোটায়। আবার কেউ কেউ বয়সে আশির কাছাকাছি। এই নেতাদের অনেকেই রাজনীতিতে ‘সক্রিয়’। তবে তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন কেউ কেউ। এর মধ্যেই দলীয় কর্মসূচিতেও তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।  স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণির বয়স ৯০ এর কোটায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে আসেন বিএনপির রাজনীতিতে। ’৭৯ সালে তিনি গাইবান্ধা থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে জিয়া সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বাসা আর হাসপাতালেই সময় কাটে তার। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সেই অর্থে এখন আর নেই কোনো যোগাযোগ। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও অনিয়মিত তিনি। স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী এম শামসুল ইসলামের বয়স ৯০ ছাড়িয়ে গেছে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত তিনি। নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও নেই কোনো যোগাযোগ। ক্রমেই মুন্সীগঞ্জের রাজনীতিতে তার দাপট কমে যাচ্ছে। অবশ্য শামসুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম বাবু তার উত্তরসূরি হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতে হাল ধরার চেষ্টা করছেন। ১৯৯১ সালে জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সিদ্দিকুর রহমানকে সরিয়ে দিয়ে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির নতুন মুখ হিসেবে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে এম শামসুল ইসলামের। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনীতির দাপটে কখনো কখনো এম শামসুল ইসলাম একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের এখন বেশির ভাগ সময় কাটে হাসপাতালে কিংবা নিজ বাসায়। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে। বেগম সারওয়ারী রহমান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। অসুখে-বিসুখে ভালো নেই তিনিও। দলীয় কর্মসূচিতেও পুরোপুরি অনুপস্থিত। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও নিয়মিত নন তিনি। নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তার সেই অর্থে কোনো যোগাযোগ নেই। গুলশানের বাসভবনে পরিবারকে নিয়ে সময় কাটছে তার।   

বিচারপতি টি এইচ খান। বয়স ৯৩। বিএনপির প্রবীণতম ভাইস চেয়ারম্যান। ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটের ঔটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ’৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আইন পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত তিনি। বরেণ্য এই বিচারপতি বার্ধক্যজনিত কারণে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। ১৯৬৮ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে যোগদান করেন।  জানা যায়, ’৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ’৭৩ সালের জুলাই মাস থেকে পুনরায় আইন পেশায় ফিরে আসেন। ’৭৯ সালে তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৮১ সালের ১৫ নভেম্বর আইন, শিক্ষা, ধর্ম, ভূমি ও রাজস্ব এবং ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিচারপতি টি এইচ খান ’৯২ সালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবীণ এ বিচারপতি প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিচারপতি টি এইচ খান আমাদের শিক্ষক। তিনি আমাদের পথপ্রদর্শক।’ অ্যাডভোকেট হারুন অর রশীদ। বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান। বয়সেও ৭৯-এর কাছাকাছি। এক সময়ের টগবগে এই রাজনীতিবিদের এখন চলাচল করতে হয় অন্যের সহায়তায়। বলা চলে, বার্ধক্যজনিত কারণে রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছেন তিনি। ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে পাঁচবার এমপিও নির্বাচিত হন। এক সময়ে জেলার জনপ্রিয় নেতা দীর্ঘদিন জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন। কিন্তু বার্ধক্য তাকে হার মানিয়েছে। এখন আর তার শরীর চলে না। তাই অনেকটা একান্তেই সময় কাটছে তার।  নূরুল ইসলাম দাদু। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রবীণ আরেক উপদেষ্টা। বয়সে তিনি ৮৪-এর কোটা পার করেছেন। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত খুলনা বিএনপির এই প্রতিষ্ঠাতা নিজ এলাকায় থাকেন বছরজুড়ে। মাঝে-মধ্যে খালেদা জিয়ার ডাক পেলে গুলশান কার্যালয়ে যান। তবে খুলনায় এখনো কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। খুলনা-৪ আসন থেকে একবার এমপিও নির্বাচিত হন।  এ প্রসঙ্গে খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘নূরুল ইসলাম দাদু ভাই আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক। টানা ২৭ বছর তিনি খুলনা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এখনো আমাদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।’ হারুন অর রশিদ মুন্নু। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। ১৯৯১ সালে মানিকগঞ্জ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে দফতরবিহীন মন্ত্রীর দায়িত্বও পান। এখন তিনি রাজনীতিতে পুরোদমে নিষ্ক্রিয়। অবশ্য তার নিজের মেয়ে আফরোজা খান রীতা মানিকগঞ্জ বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে আছেন। ঢাকা ও মানিকগঞ্জে হাসপাতালে কিংবা বাসায় সময় কাটে তার। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতেও অংশ নেন না তিনি। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তার দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হয় না। দলের প্রবীণ এই রাজনীতিবিদদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই নেতারা বিএনপির সম্পদ। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। দল পুনর্গঠন করা হলে তাদের অবশ্যই সম্মানজনকভাবে বিদায় দিতে হবে। তাদের থেকে এখনো আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। এই নেতাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তরুণ নেতৃত্বকে বিএনপির হাল ধরতে হবে।’

সর্বশেষ খবর