শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিএনপির এখনো ভয় মামলা

২৫ হাজারের তালিকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে

মাহমুদ আজহার

বিএনপির এখনো ভয় মামলা

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ’ তরিকুল ইসলাম সব মামলায় জামিনে থাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য যেতে চেয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে। পাসপোর্ট নবায়নের জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গত ৫ অক্টোবর বিকালে গিয়েছিলেন আগারগাঁওয়ের অফিসে। ওইদিন রাতেই যশোরে তাকেসহ জেলা বিএনপির ৩৪ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার একটি মামলা দায়ের করা হয়। আটকে যায় তার চিকিৎসার উদ্দেশে বিদেশযাত্রা। এরপর থেকে আড়ালে রয়েছেন বিএনপির প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। দেশের বাইরে যেতে চাইলে তাকে জামিনের আবেদন নিয়ে আবারও আদালতে দৌড়াতে হবে।

সম্প্রতি জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডের পরপরই রংপুর থেকে মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী বিপ্লব ও জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান লাকুকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের এক দিন পর নাশকতার মামলায় জড়ানো হয় যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুকে। পুরনো মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতা জিল­ুর রহমান খোকন ও নবী হোসেন। একই অভিযোগে সম্প্রতি কারাগারে পাঠানো হয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসরাইল মিয়া এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদকেও। সারা দেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের চালচিত্র প্রায় একই। জানা যায়, বিএনপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পাশাপাশি দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই গ্রেফতার-মামলার এই নয়া ফাঁদে পড়ে বিএনপি। একই সঙ্গে ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতসহ অন্য দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারও বেড়ে যায়। ঢাকাসহ সারা দেশে তালিকা ধরে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে সবমিলিয়ে বিএনপি জোটের সহস াধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে মামলা-সংক্রান্ত কাগজ-পত্রের পাহাড় সমান স্ত‚প জমা হচ্ছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মামলার পরিসংখ্যান তৈরি করা হচ্ছে। তালিকা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত গ্রেফতার হওয়া নেতা-কর্মীদের। কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের তালিকা তৈরির পাশাপাশি মামলার পরিসংখ্যানও তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত যেভাবে গ্রেফতারের পাশাপাশি মামলার তালিকা আসছে, তাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “দল পুনর্গঠন ও সুসংহত করার প্রক্রিয়ায় বিঘœ সৃষ্টি করতেই নেতাদের গ্রেফতার ও নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। দল পুনর্গঠনে যেসব নেতার প্রয়োজন তাদের অনেককে আগে থেকেই গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। আবার অনেককে নতুন নতুন মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম যাতে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে না পারেন, সে জন্য ‘কাল্পনিক গল্প’ তৈরি করে তাকেসহ ৩৪ জন নেতা-কর্মীর নামে ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ মামলা দেওয়া হয়েছে। এভাবে একটি গণতান্ত্রিক দলের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না।”

বিএনপির অভিযোগ, দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের ওপর গ্রেফতারের খড়গ নেমে আসে। পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার পাশাপাশি সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকি আসছে। সর্বশেষ বিদেশি দুই নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দেওয়ার পর গ্রেফতার অভিযানের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের বাসায় বাসায় প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে। নিত্যনতুন মামলার ফাঁদে আটকানো হচ্ছে নেতা-কর্মীদের। নেতা-কর্মীদের না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের ওপরও দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার মামলার ফাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আরও অন্তত ৫ হাজার মামলা তৃণমূল থেকে সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেই রয়েছে ২৭ মামলা। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। মানহানিসহ ৮৪টি মামলা রয়েছে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। সমসংখ্যক মামলা রয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও। দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে সারা দেশে বিএনপির অন্তত ৫ লাখ নেতা-কর্মী আসামি বলেও জানানো হয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে।

জানা যায়, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে মির্জা আব্বাসের নামে। তার বিরুদ্ধে ৪৭টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ৩৮টি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ৩৭টি, এম কে আনোয়ার ৩৬টি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৬টি, আ স ম হান্নান শাহ ১৫টি, তরিকুল ইসলাম ১২টি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১২টি, নজরুল ইসলাম খান ৯টি এবং ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ২টি মামলার আসামি। এর মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও রয়েছে। সম্প্রতি নাশকতার এক মামলায় হাজিরা দিতে গেলে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারকে। রাজধানীর পান্থপথে সামুরাই কনভেনশন সেন্টারের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে। তার বিরুদ্ধেও প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার কারণেই এম কে আনোয়ারকে কারাগারে পাঠানো হয় বলে বিএনপির অভিযোগ। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক আবদুল মান্নান, সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউসসহ সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছেন। একইভাবে জেলের ভিতরে-বাইরে থাকা অন্তত ৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৩০ হাজার মামলার খড়গ ঝুলছে বলে বিএনপির দফতর সূত্র জানায়। বিএনপি সূত্র জানায়, গত দুই সপ্তাহ ধরে সারা দেশের সব জেলায় কমবেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আবার নিæ আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া নেতা-কর্মীদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জেই ৭০ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার, স›দ্বীপ, ভোলা, যশোর, কিশোরগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ সারা দেশেই নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গত সোমবার যশোর সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কামালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়সল আহমদ এবং ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম সিরাজকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে দিতেই ক্ষমতাসীন সরকার নতুন করে জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার-হয়রানি করছে। নতুন নতুন মামলায় জড়ানো হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দলের বহু নেতা-কর্মী আজ জেলে বন্দী। ফেরারিও আছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। উচ্চ আদালত  থেকে জামিন নিয়েও রেহাই মিলছে না। তিনি আরও বলেন, এভাবে অত্যাচার-জুলুম করে বিএনপিকে দুর্বল করা যাবে না। আমাদের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি থেকেও সরানো যাবে না।’ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে প্রায় সব মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আদালত থেকে ন্যায়বিচার পেলে একটি মামলাও টিকবে না। তা ছাড়া ওয়ান-ইলেভেনে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, একই ধরনের মামলা হয়েছিল আজকের প্রধানমন্ত্রীর  বিরুদ্ধেও। তিনি সব মামলা থেকে রেহাই পেলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখনো ওইসব মামলার আসামি। আশা করছি, এসব মামলায়ও উচ্চ আদালত থেকে আমরা ন্যায়বিচার পাব।

তরিকুলসহ ৩৪ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা : নিজস্ব প্রতিবেদক যশোর জানান, ৫ অক্টোবর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ ৩৪ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা হয়েছে। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় ৪ অক্টোবর রাতে আটক হওয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুকে। অন্য আসামির মধ্যে রয়েছেন যশোর নগর বিএনপির সভাপতি ও পৌরসভা মেয়র মারুফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, জেলা কমিটির সহ-সভাপতি রফিকুর রহমান তোতন, অ্যাডভোকেট জাফর সাদিক, সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন প্রমুখ।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর