বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তেলের দাম কমালে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে

জিন্নাতুন নূর

তেলের দাম কমালে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে

অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশে তেলের দাম কমালে অর্থনীতির একটি নতুন গতি তৈরি হবে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন ভাড়া কমবে। এক ধরনের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। উৎপাদনমুখী তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। এতে করে অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়া সম্ভব। এমনকি বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। কিন্তু সরকার জনগণের ভোগান্তি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে কিছু লোকজনকে খুশি করতে গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ- এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের ‘মাথা নত অবস্থান’-এর কারণে জ্বালানির দাম কমানো হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম যেখানে কমছে সেখানে আমাদের দেশে জ্বালানির দাম না কমানোয় সার্বিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই কারণে যে, জ্বালানি তেলের দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারের মতো আমাদের দেশেও কমানো হতো তবে এখন তেলের দাম যা আছে তা অর্ধেকে নামত। বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে যেখানে তেলের দাম কমানো হচ্ছে সেখানে সরকার তেলের দাম না কমিয়ে একটি বড় ধরনের সুযোগ হারিয়েছে।

অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কারণে সরকার তেলের দাম কমায়নি। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাধা পড়ার কারণে এবং তাদের কাছে সরকারের ‘মাথা নত অবস্থানের’ কারণে সরকার তেলের দাম কমাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নীতি হচ্ছে, মজুরি ছাড়া ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত সমস্ত কিছুর দাম বৃদ্ধি করা। কারণ, তারা সরকারকে ঋণ দেয় এমন ধরনের শর্ত আরোপ করে যেন ক্ষেত্রবিশেষে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, তেল, বেতন ফি, পরিবহন ব্যয় সবকিছুরই দাম বৃদ্ধি করার জন্য সরকারকে চাপ দিতে পারে। কাজেই তাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক তৈরি করলে যে কোনো কিছুর দাম বৃদ্ধির জন্য এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। আর সরকার এগুলোর কাছে অবনত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও প্রতিনিধিত্ব করে বাণিজ্যিক স্বার্থে। এ জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসহ দেশীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা এই দাম বৃদ্ধি করে। কারণ, সবকিছুর দাম যদি বাড়ে তাহলে প্রফিট মার্জিন বেড়ে যায়। তারা আরেকটি জিনিস চায় তা হলো তারা ব্যক্তি মালিকানা তৈরি করতে চায়। কারণ, কোনো কিছুর দাম বাড়লে ব্যক্তি মালিকানায় যারা থাকে তাদের লাভ হয়। এমনকি তারা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) ব্যক্তি মালিকানায় নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার জানা মতে, এ জন্য এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখানে দাম বেশি থাকলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ হয়। তারা কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে। অর্থাৎ দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সারা দেশের মানুষ যারা উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় কমলে লাভবান হতেন এবং উৎপাদন গতিশীলতা পেতে সেটি থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, কৃষকরা সেচের জন্য ডিজেল ব্যবহার করেন। জ্বালানির দাম না কমালে কৃষকদের ওপর এর প্রভাব পড়ে। কারণ, তারা যে দামে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেন তার সঙ্গে তারা যে দামে বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে তার মধ্যে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে। যেভাবে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে তার সঙ্গে তারা যে দামে বাজার থেকে তেল কিনছে তা মিলছে না। আমরা যে দামে কৃষিপণ্য কিনি তার চেয়ে অনেক কম দামে কৃষকরা বাজারে কৃষি পণ্য বিক্রি করেন। বাজারের মধ্যে কিছু গোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে এটা হয়। এরকম সংকটের মধ্যে উৎপাদন ব্যয় যদি কোনোভাবে কমানোর সুযোগ থাকে তবে কৃষক ও কৃষির জন্য তা হবে বড় উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু সরকার সেই সুযোগ হাতছাড়া করছে।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, সাম্প্রতিক গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এ ধরনের সিদ্ধান্তে গোয়াতুর্মি ছিল। কোনো যুক্তি, তর্ক ও গণশুনানিতে সরকারের পক্ষ থেকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য কারণ দেখানো হয়নি। অন্যদিকে গণশুনানিতে মূল্যহ্রাসের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও গণশুনানির ফলাফলকে সরকার অগ্রাহ্য করল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের যে বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হলো সেখানে অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব যেন স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে পারেন সে জন্য দাম বৃদ্ধি করা হলো। কিন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার অর্থ শুধু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা নয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য অনেক কিছুরই দাম বাড়বে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে পরিবহন ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ঘটনায় এখন এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। এর ফলে বাস মালিকরা যতটা বাস ভাড়া বৃদ্ধির কথা তার চেয়ে অনেক বেশি বাস ভাড়া বাড়িয়েছেন। আর পরিবহনে যারা চলাচল করে তারা অধিকাংশই নিম্নআয়ের মানুষ। বাসে শিক্ষার্থী, মধ্যবিত্ত যারা চলাচল করেন তাদের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। এ জন্য একটি পরিবারে যদি চারজন বাসে যাতায়াত করেন তবে সেই পরিবারে মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর একটি সীমিত আয়ের পরিবারের জন্য এটা বড় ধরনের চাপ। ফলে গ্যাসের বাড়তি দামের ফলে অন্যান্য জিনিসের বাড়তি দামের চাপও জনগণের ঘাড়ে পড়ল।

সর্বশেষ খবর