শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির মধ্যেও থেমে নেই দস্যুতা

সামছুজ্জামান শাহীন, সুন্দরবন থেকে ফিরে

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির মধ্যেও থেমে নেই দস্যুতা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো তৎপরতার মধ্যেও সুন্দরবনকেন্দ্রিক বনজীবীনির্ভর দস্যুতা চলছেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় বনদস্যুদের শিকার হচ্ছেন জেলেরা। চাঁদা দিতে হচ্ছে নিয়মিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কড়াকড়িতে বনদস্যুরাও চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে বনদস্যুদের একাধিক গ্রুপ বেঙ্গল টাইগার শিকার করে এর চামড়াসহ অঙ্গ-প্রতঙ্গ পাচারে জড়িত হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন ১০ অক্টোবর সুন্দরবনের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের একাধিক বনজীবী বলেন, সম্প্রতি বনদস্যুদের দৌরাত্ম্য ফের বেড়েছে। তারা আগে সুন্দরবনের মধ্যে জেলে-বাওয়ালিদের মারধর করে টাকা, চাল-ডাল লুটে নিত। এখন উল্টো বনে প্রবেশের আগেই গ্রামে থাকা তাদের লোকের কাছে ধার্য চাঁদা পরিশোধ করে স্লিপ নিয়ে বনে যেতে হয় বনজীবীদের। এই স্লিপ ছাড়া বনে গেলে নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়। স্লিপের ধরনও পাল্টেছে। এখন ডাকাতদের স্লিপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে দুই ও পাঁচ টাকার নোট। ওই নোটের নম্বরটিই চাঁদা প্রাপ্তির সংকেত। একই ধরনের কথা বলেছেন খুলনার কয়রা, বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা এলাকার একাধিক বনজীবী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়রা উপজেলার কয়েকজন জেলে বলেন, বনদস্যুরা আগে নৌকাপ্রতি এক হাজার টাকা চাঁদা নিত। র‌্যাব ও পুলিশের কড়াকড়ির পর তারা এ চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতি নৌকার জন্য দুই হাজার টাকা ধার্য করেছে। বনে প্রবেশের আগেই এই চাঁদার টাকা ডাকাতদের কাছে বিকাশ করে বা নগদে দিতে হচ্ছে। সরেজমিন ১১ অক্টোবর দোবেকি ফরেস্ট স্টেশনে আসা নীলডুমুরের আবদুর রশিদ ও হাবিবর গাজীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ওই দিন ভোরে দোবেকি ফরেস্ট স্টেশনের গোবরাখালী এলাকা থেকে সশস্ত্র বনদস্যুরা মারধর করে বেশ কয়েকজন জেলের টাকা-পয়সা ও মালামাল লুটে নেয়। ডাকাতরা দুই জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। বনদস্যুদের এই অত্যচার নিত্যদিনের। ডাকাতরা বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে। বললেন দুই জেলে। জানা যায়, দোবেকি ফরেস্ট স্টেশন এলাকা মোজাম, খোকা ও জোনাব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। দোবেকি ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেক মিয়া বলেন, সুন্দরবন স্থলপথ নয়, নদীপথ। বনদস্যুদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। সে ধরনের শক্তিশালী জলযান নেই। বনদস্যুদের উপদ্রব কমাতে কোস্টগার্ডের সহায়তা নিয়ে কাজ চলছে বলে দাবি এই কর্মকর্তার। অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের মাঠপর্যায়ের লোকদের সঙ্গে কোনো কোনো ডাকাত বাহিনীর সখ্যও রয়েছে। আবার কখনো কখনো ডাকাতদের কাছে অসহায়ের মতো নিজেদের সঁপে দিতে বাধ্য হন বনকর্মীরা। জেলে-বাওয়ালিদের অভিযোগ, বনকর্মীরা ও স্থানীয় থানা পুলিশ ডাকাতদের গতিবিধি জেনেও বেশির ভাগ সময় চুপ থাকেন। জানা যায়, আগস্ট মাসে সুন্দরবনের খাসিটানা এলাকায় বনদস্যুদের আস্তানা উচ্ছেদ না করা এবং এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানানোর অপরাধে একজন ফরেস্টারসহ পাঁচজন বনকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ডাকাতদের প্রতিরোধ বিষয়ে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জহিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান অবস্থায় দস্যুদের এককভাবে মোকাবিলার সক্ষমতা বনরক্ষীদের নেই। এমনকি বনের মধ্যে অনেক বিট অফিসের রক্ষীদের অস্ত্রের পরিবর্তে শুধু লাঠি দিয়ে বন পাহারা দিতে হয়। ফলে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় দস্যু মোকাবিলা চলছে। ৯ আগস্ট সুন্দরবনের কয়রা উপজেলা অংশে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে স্থানীয় ছয়জন বাঘশিকারি নিহত হন। এ বিষয়ে খুলনা জেলা পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা দিয়েছিল। ওই সম্মেলনে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি এস এম মনির-উজ-জামান বলেন, বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া ছয়জন বনদস্যু ইলিয়াস ও জাহাঙ্গীর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিল। তারা দস্যুতার পাশাপাশি বাঘ শিকার করে পাচার করে আসছে। সম্মেলনে উপস্থিত খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, বনরক্ষীদের কাছে যে অস্ত্র আছে, তা দিয়ে বন দূরে থাক, তারা নিজেদেরই রক্ষা করতে পারেন না। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী খুলনায় বন আদালত থাকার কথা থাকলেও তা নেই। অন্য আদালতে বন মামলা পরিচালনা করতে হয়। ফলে অন্য মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে বন মামলার গুরুত্ব কমে যায়। এতে করে অপরাধীরা বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। এ জন্য খুলনায় বন আদালত স্থাপন জরুরি। জানা যায়, বনদস্যু দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও বসে নেই। তারাও নিত্যনতুন কৌশলে ডাকাতদের ধরার অভিযান চালাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সুন্দরবনে ৩১টি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে। এ সময় বন্দুকযুদ্ধে ৪১ বনদস্যু নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন ১৮ জন। উদ্ধার করা হয়েছে ১৬১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৬৯৭ রাউন্ড তাজা গুলি, জলযানসহ নানা সরঞ্জাম। নিহত বনদস্যুদের মধ্যে চারজন বাহিনীপ্রধান ও দুজন বাহিনীর উপপ্রধান রয়েছেন। র‌্যাব-৬, খুলনার পরিচালক (সিও) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বনদস্যুদের অপতৎপরতা বন্ধে নিত্যনতুন কৌশলে অভিযান চলছে। বনদস্যুরা আগের তুলনায় এখন অনেকটা কোণঠাসা। অনেকগুলো প্রভাবশালী গ্রুপকে নিষ্ক্রিয় করা গেছে। কোনো কোনো গ্রুপ দস্যুতা ছেড়েও দিয়েছে। তবে সুন্দরবন বনদস্যুদের উর্বর ক্ষেত্র। নিত্যনতুন বনদস্যু দল তৈরি হচ্ছে। এসব ডাকাতের বিরুদ্ধে তৎপরতাও আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সুন্দরবন এলাকাটা যোগাযোগের দিক দিয়ে এখনো দুর্গম। দ্রুত পৌঁছানোর মতো জলযান নেই। বনের মধ্যে র‌্যাবের কোনো ক্যাম্পও নেই। ফলে বনদস্যুদের সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থান ও তৎপরতা বিষয়ে তথ্য পেতে দেরি হয়। আবার তথ্য পেলেও শুধু দূরত্বের কারণে খুলনা শহর থেকে প্রস্তুতি নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। পৌঁছানোর আগেই তারা নিরাপদ অবস্থানে চলে যায়। একই সঙ্গে র‌্যাবের অভিযানের ফলে বনদস্যুরা ছোট ছোট নতুন দল তৈরি করছে। তাদের নেতৃত্বের মুখগুলোও নতুন। এসব বিষয়ে প্রশাসন সজাগ আছে।

সর্বশেষ খবর