সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তাজিয়ার প্রস্তুতিতে হামলা ও পুলিশ হত্যা একসূত্রে

হামলাকারী দুজন মামলা ডিবিতে

সাখাওয়াত কাওসার

তাজিয়ার প্রস্তুতিতে হামলা ও পুলিশ হত্যা একসূত্রে

পুরান ঢাকার হোসনি দালানে শুক্রবার রাতে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলায় আহতদের অনেকেই শিশু। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুজন -জয়ীতা রায়

পবিত্র আশুরায় পুরান ঢাকার হোসনি দালানের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হামলা আগের দিন রাজধানীর গাবতলীতে দুর্বৃত্তের হামলায় পুলিশ সদস্যের মৃত্যু একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তবে র‌্যাবের দাবি, শুধু এ দুটি নয়, চট্টগ্রামের হামজা ব্রিগেড, আশুলিয়ায় বহুল আলোচিত ব্যাংক  ডাকাতি এবং হোসনি দালানে গ্রেনেড বিস্ফোরণও একই সূত্রে গাঁথা। অন্যদিকে হোসনি দালানের ভিতর এবং বাইরে থাকা ৩২টি ক্যামেরার ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দুই যুবককে শনাক্ত করেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় চকবাজার থানায় মামলা হয়েছে। এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ জন আহত। এ ঘটনার পর গতকাল পর্যন্ত আতঙ্ক কাটেনি শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বেলা ১১টার দিকে পুলিশ হোসনি দালানের ভিতর থেকে হাতে তৈরি গ্রেনেডের তিনটি সেফটি পিন উদ্ধার করেছে। তবে ঘটনার পরপর একটি সেফটি পিন উদ্ধার করেছিল র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। বৃহস্পতিবার রাতে গাবতলীতে চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা ইব্রাহিম মোল্লা নামে এক পুলিশ সদস্যকে যে চক্র হত্যা করেছে পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে যেসব হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে সেসবের সঙ্গে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের মিল রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এ কারণে পুলিশ হত্যার ঘটনায় আটককৃত সবাইকে বোমা হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, চট্টগ্রামের হামজা ব্রিগেড, আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি এবং সর্বশেষ হোসনি দালানে হামলা প্রতিটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এসব ঘটনায় উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকগুলোও একই ধরনের। এসব কারণে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো জিআই পাইপ কেটে ভিতরে ডেটোনেটর বসিয়ে তৈরি করা হয়। এর ভিতরে বিস্ফোরক থাকলেও স্পি­ন্টার ছিল না। প্রতিটি গ্রেনেডের ওজন ছিল আনুমানিক ৬০০ গ্রাম করে। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা জানান, হাতে তৈরি এসব গ্রেনেডের ভিতরে ১৫০ ভোল্টের ৪টি করে ব্যাটারি যুক্ত করা ছিল। আর পিন খোলার ৫ সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরিত হবে এমনভাবে এসব তৈরি করা হয়েছিল। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ও হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো মধ্যম মানের। পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ইতিমধ্যে বলেছেন, শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের ওপর হামলার সঙ্গে দুই দিন আগে গাবতলীতে এএসআই খুনের যোগসূত্র রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। গত বৃহস্পতিবার গাবতলীতে পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন এএসআই  ইব্রাহিম মোল্লা। তখন ঘটনাস্থল থেকে মাসুদ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থেকে বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধারের কথা শুক্রবার জানিয়েছিল পুলিশ।

হামলাকারী দুজন : ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তাজিয়া মিছিলের হামলায় অংশ নিয়েছিল দুই দুর্বৃত্ত। দুজনের মধ্যে একজন হাতে তৈরি গ্রেনেডগুলো ছুড়ে মারে। অপরজন ছিল তার সহযোগী। সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারী দুজনের একজনকে বোমা নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ইমামবাড়ার ভিতরের কবরস্থানের কর্নার থেকে বোমা হামলা চালানো হয়। ওই জায়গাটি কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। এ কারণে দুর্বৃত্তরা ওই স্থানে গিয়ে হামলা চালায়। সিসিটিভির ফুটেজে তাদের চেহারা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না। তবে চেহারা দেখে তাদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলছে। ইমামবাড়ায় সাধারণ সময়ে তাদের নিজস্ব ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো থাকে। তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে আরও ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। সব ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। হামলাকারী দুর্বৃত্তরা ছদ্মবেশে ইমামবাড়ায় ঢুকেছিল।

থানায় মামলা : বোমা হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছে পুলিশ। সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩) এর ধারা ৬(২) এর (এ) (বি) (সি) (ডি) (ই) মোতাবেক অপরাধ হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। গতকাল দুপুরে চকবাজার থানার উপ-পরিদর্শক জালাল উদ্দীন বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম।

তদন্ত কমিটি : চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হোসনি দালানে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের গাফিলতি ছিল কিনা তা তদন্ত করে দেখবে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) মীর রেজাউল আলম ও ডিবির (পূর্ব) উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ।

হামলার দায় স্বীকার, আমলে নিচ্ছে না সরকার : হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেটের (্আইএস) বক্তব্যটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ‘কিছু হলেই’ আইএসের নামে দায় স্বীকারের যেসব বার্তা আসছে, তার পেছনে ‘অন্য কোনো উদ্দেশ্য’ রয়েছে। বাংলাদেশে ‘সাংগঠনিকভাবে’ আইএসের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ পায়নি গোয়েন্দারা। অথচ একটা কিছু হলেই তাৎক্ষণিকভাবে আইএস বিবৃতি দিচ্ছে। প্রপাগান্ডা হতে পারে, উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তদন্ত করছি। যারাই হরকাতুল জিহাদ, তারাই হুজি, তারাই জেএমবি, তারাই আনসারুল্লাহ, তারাই শিবির। সবই এক সূত্রে গাঁথা।’ আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি। এখানে অন্য কোনো টেরোরিস্ট থাকতে পারে। তদন্ত করছি, শেষ হলে স্পষ্ট করে প্রকাশ করব।

হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ১৬ জন : গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত ১৬ জন ঢামেক হাসপাতালের ১০১, ২০৪, ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাদের মধ্যে জামাল হোসেনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। জামালকে আইসিইউতে (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ১৬ জনের বাইরে আহত অনেকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরা হলেন- রিনা খাতুন (৩৮), সারোয়ার হোসেন (৬), মো. জনি (২৫),  নূর হোসেন (৫৫), আয়েশা বেগম (৫০), জামাল হোসেন (৫৫), রুনা বেগম (৩০), মেহেদী (১১), মনির হোসেন (৯), হালিমা আক্তার (২০), কামাল হোসেন (২২), ইকরামুল হোসেন (২৬), কায়েস (২), হাসান (৬), রাকিব (২৬), রাসেল হোসেন (৩০)। ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন জনি। তার পায়ে একাধিক স্পি­ন্টার বিদ্ধ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অতি দ্রুত তার অপারেশন করতে হবে। গুরুতর আহত একরাম হোসেন বলছিলেন, আমি স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। একটি ছোট বস্তু আমার পায়ে এসে লাগলে সেটি বিস্ফোরিত হয়। আমার বুক, দুই হাত, দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পি­ন্টার বিদ্ধ হয়। আর কিছু মনে নেই আমার। তার ধারণা, ওই বোমা হামলা কোনো ছাদ থেকে করা হয়নি। সন্ত্রাসীরা হাতে করে নিচ দিয়ে গড়িয়ে দিয়েছে। এতে ওই বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে।

পুলিশ হত্যা মামলায় পাঁচ আসামি রিমান্ডে : রাজধানীর দারুস সালাম থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ইব্রাহিম মোল্লা হত্যা মামলায় পাঁচ আসামিকে ছয় দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম লুৎফর রহামান শিশির এ আদেশ দেন। এর আগে মামলা তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। আসামিরা হলেন- শেখ রফি আহমেদ, ইউনুস আলী, মাসুদ রানা, খন্দকার মেহেদী হাসান ও শফিকুর রহমান। প্রসঙ্গত, আশুরা উপলক্ষে নাজিম উদ্দিন রোডে হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় শনিবার প্রথম প্রহরে বোমা হামলার ওই ঘটনা ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউর নিন্দা ও বিচার দাবি : রাজধানীর হোসনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিতে বোমা হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। গত দুদিনে পৃথক তিন বার্তায় দেশ ও জোটগুলোর রাষ্ট্রদূতরা নিন্দা প্রকাশ করে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট এক বিবৃতিতে বলেন, শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা অনর্থক। হামলায় হতাহত এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে আমরা পাশে আছি। ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, ‘আশুরা উপলক্ষে শিয়া সম্প্রদায়ের শোভাযাত্রায় এ হামলার ঘটনায় আমি আতঙ্কিত। এ ধরনের সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানান ব্রিটিশ হাইকমিশনার। অন্যদিকে, ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর জোট ইইউর রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি দলের প্রধান পিয়েরে মায়দু গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরনের নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ ঐক্যের পরিচয় দেবে। একই সঙ্গে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচার করবে বলেও ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধানের বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়।

সর্বশেষ খবর