বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সব যেন রহস্য উপন্যাস

খুন করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় খুনিরা, গোয়েন্দা কাহিনীকেও হার মানায়

সাঈদুর রহমান রিমন

সব যেন রহস্য উপন্যাস

গভীর আঁধারের সীমাহীন রহস্যময়তায় ঢাকা পড়েছে সারা দেশ। ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের গুজব-আতঙ্ক। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। খোদ রাজধানীর জনাকীর্ণ স্থানগুলোয় একই স্টাইলে একের পর এক খুন-খারাবি ঘটিয়ে চলেছে রহস্যমানবরা। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই প্রশাসনযন্ত্র নড়েচড়ে ওঠে, শুরু হয় ছোটাছুটি। কিন্তু খুনিদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না তারা। ক্ষিপ্রতায় প্রশিক্ষিত র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী, ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও দুর্বৃত্ত সন্ধানে মাঠে নেমে গলদঘর্ম হচ্ছেন। কিন্তু রহস্যের আঁধার কাটাতেই পারছেন না।

প্রায় প্রতিটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরই পুলিশসহ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ‘ঘটনার ক্লু মিলেছে, শনাক্ত হয়েছে খুনি কিংবা খুনিদের ঘিরে আছে গোয়েন্দা জাল’ ইত্যাদি গালগল্প আউড়িয়ে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত থাকছেন। আবার কখনো তারা শোনাচ্ছেন প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তের নানা কথা কিন্তু কিছুতেই সুফল মেলে না, ধরা পড়ে না খুনিরা। এমনকি খুনিদের নিছক চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও সীমাহীন ব্যর্থতা দেখাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বরং সংঘবদ্ধ খুনিরা প্রশাসনের দক্ষতা-তৎপরতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধারাবাহিক খুনোখুনি চালিয়েই যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগাম ঘোষণা দিয়েই ঘটানো হচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

খুনিরা অভিন্ন স্টাইলে প্রকাশ্য দিবালোকে কিংবা সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটালেও প্রশাসন ‘খুনের মোটিভ’টা পর্যন্ত উদ্ঘাটন করতে পারছে না। কোথাও টার্গেটকৃত একক কাউকে, কোথাও দুই বা তিনজনকে আবার কোথাও একসঙ্গে ছয়জনকে পর্যন্ত জবাই করে হত্যা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই ‘রহস্যমানব খুনিরা’ পরমুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। অনেক ঘটনার পরপরই র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি সদস্যরা ৮-১০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে অসংখ্য চেকপোস্ট বসিয়ে, বাড়িঘর পর্যায়ে চিরুনি অভিযান চালিয়েও খুনিদের নাগাল পাচ্ছে না। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলেন। রাজধানীতে ঘন ঘন চেকপোস্ট, র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবির কড়া টহলব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারির মধ্যেও একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনা কীভাবে ঘটছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এতসব তৎপরতার মধ্যেও খুনিরা চোখের পলকেই কোথায় লাপাত্তা হচ্ছে? হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ তদন্তেও কেন খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না? সব টার্গেট পূরণ করেও নিজেদের নিরাপদ রাখার মতো নিখুঁত পরিকল্পনা আঁটতে পারদর্শী এসব খুনি কল্পকাহিনীর দস্যু বনহুর বা মাসুদ রানার চেয়েও উচ্চমাত্রার চমক সৃষ্টি করে চলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের প্রশিক্ষণ, তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা ও তড়িৎ গতির সামনে কি দেশসেরা গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও অসহায়? খুনিদের সামনে ‘নিজেদের অসহায় ও ব্যর্থ’ প্রমাণ করে মহানগর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উম্মোচনে অক্ষমতার ঘোষণা থেকেই ধারাবাহিক ব্যর্থতার ছবি আঁকা শুরু হয়েছে। ধূর্ত খুনিরা নানা রকম অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যস্ত রেখেই একের পর এক টার্গেট পূরণ করে চলছে। তাদের পূর্বঘোষিত তালিকা অনুযায়ী একেকজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে চলছে। তাদের আটক করা যাচ্ছে না, শনাক্ত পর্যন্ত করতেও ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। ফলে অজানা খুনিদের উদ্দেশে দেশবাসীর প্রতিবাদ চলছে, অন্যদিকে প্রশাসন হাতড়ে ফিরছে খুনের রহস্য। আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদে বেশ কিছু আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ব্লগার, প্রকাশক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব কেউ বাদ যাচ্ছে না। গা শিউরে ওঠা এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই বিচার হয়নি। তদন্ত আর অধিকতর তদন্ত এবং অনাস্থায় বিভাগ বদলের মাধ্যমে বার বার মামলার দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়েছে কেবল। পুরান ঢাকার গোপীবাগের আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর নৃশংস ছয় খুনের তদন্ত চলছে তো চলছেই। ২০ মাস ধরেই তদন্ত চলে আসছে। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর পরিকল্পিতভাবে ছয়জনকে হত্যা করা হলেও খুনিদের কাউকেই এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের ক্লুটি পর্যন্ত পাচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তা। ছয় খুনের মামলার এখন পর্যন্ত হত্যায় জড়িত সন্দেহে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু সেসব তথ্য এ সিক্স মার্ডারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা, সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত হয়নি এখনো। গত একুশে বইমেলা চলাকালে জনাকীর্ণ টিএসসি এলাকায় ব্যস্ততম রাস্তার পাশেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ব্লগার অভিজিৎ রায়। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বজুড়েই ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। পুলিশের নাকের ডগায় হত্যা করে পালিয়ে গেল খুনিরা। এখনো কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। অভিজিৎ রায়ের খুনি কারা? জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার বাংলা সেভেন’ অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করে এটিকে বিজয় উল্লেখ করে উল্লাস প্রকাশ করেছে। অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এখনো অন্ধকারেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। এখনো অভিজিৎ হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি পুলিশ।

মাওলানা ফারুকী হত্যাকাণ্ড : ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাত সোয়া ৯টার দিকে ১৭৪ পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাড়ির দোতলায় বহুল আলোচিত ইসলামী ফ্রন্ট নেতা ও টেলিভিশন উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে (জবাই) ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পর এর তদন্তের দায়ভার ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগকে (ডিবি) দেওয়া হয়। প্রযুক্তিগত দুর্বলতার জন্য হত্যাকাণ্ডের এক বছরে মামলার কোনো ক‚লকিনারা করতে না পারায় এখন তদন্তের ভার সিআইডির কাছে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কমিশনার বলছেন, মামলার তদন্ত চলছে। পেশাদার ও প্রশিক্ষিত খুনিরা হত্যাকাণ্ডের আলামত না রাখার সব ধরনের চেষ্টা করেছে। তার পরও খুনিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হতে না হতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। ব্লগার, লেখক বা অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট হত্যাকাণ্ডে যখন সারা দেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে, ঠিক তখনই ‘পীর’ ও ‘মাওলানা’দের হত্যা এ আতঙ্কে আরও নতুন মাত্রা যোগ করছে। পীর ও মাওলানাদের শত্র“ থাকতে পারে এমনটি আগে কেউ চিন্তা করতে পারেনি। অথচ গত দুই বছরে একইভাবে পীর ও মাওলানা হত্যার চারটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। ইসলামী শরিয়তের পরিপন্থী ও বিপরীত মতাদর্শ প্রচারকে এ হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণ হিসেবে ধারণা করছেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সর্বশেষ চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজার পূর্বাচল এলাকায় জুমার নামাজের পর ‘লেংটা মামার মাজার’-এর পীর রহমত উল্লাহ ওরফে লেংটা মামা (৫২) ও খাদেম আবদুল কাদেরকে (২৫) জবাই করেছে দুর্বৃত্তরা। খিলগাঁওয়ে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়। এ হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন দু-চার জনকে আটক করা হলেও প্রকৃত খুনিদের হদিস খুঁজে পায়নি পুলিশ। ৭ আগস্ট দুপুরে নিজ বাড়িতে খুন হন নিলয়। হত্যা মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশকে দেওয়া হলেও তা অন্ধকারেই থেকে গেছে। ১২ মে দিনদুপুরে ব্যাংকে যাওয়ার পথে খুন হন সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। ঢাকার বাইরে এটাই একমাত্র ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। আদালতে প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপন করতে না পারায় মামলার শুনানি শুরু হয়নি এখনো। আসামি হাতেনাতে ধরা পড়া সত্তে¡ও এখনো চলছে ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যার বিচার। ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রাস্তার ওপর কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। এ সময় হামলাকারীদের দুজনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এ হত্যা মামলায় পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে সেপ্টেম্বরে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও এখনো বিচারিক কার্যক্রম শুরুই হয়নি।

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর