শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

বাংলাদেশি টুরিস্টদের নিউমার্কেটে কেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ

সমরেশ মজুমদার

বাংলাদেশি টুরিস্টদের নিউমার্কেটে কেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ

ধর্মতলায় কিছু মানুষের সামনে একজন রাজনৈতিক নেতা সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে গো-মাংস ভক্ষণ করছেন। তিনি যে রাজনৈতিক দলের সমর্থক তার ঠিক বিপরীত মেরুর ভাবনা নিয়ে যে দল এখন পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছে সেই দলে সদ্য যোগ দেওয়া এক কবি পাশে দাঁড়িয়ে সেই মাংসের স্বাদ গ্রহণ করছেন। দুজনের চোখে-মুখে যে উল্লাস ফুটে উঠেছিল তা টিভির ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।

যেভাবে দ্রুত ওই মাংস চিবিয়ে নরম করে ওরা গলার ভিতর দিয়ে উদরে পাঠাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল, গো-মাংস নয়, শিবসেনা অথবা বিজেপি যে অকারণ অস্থিরতার আমদানি করেছে, তা এখনই দূর হয়ে যাবে। মনে পড়ল আমার মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। বলেছিলেন, ‘স্থবিরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অবশ্যই উচিত, কিন্তু উৎকটভাবে নয়। এই যে কলেজ স্কোয়ার, এখানে বসে ডিরোজিওর বিপ্লবী শিষ্যরা পা ছড়িয়ে বসে গরুর মাংস খেয়ে হাড় ছুড়ে ফেলেছিল। সেই সময়ে কোনো হিন্দু বাঙালি যুবক গরু খাচ্ছে, তা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। কিন্তু তাতে কী হলো? ওই আন্দোলন ধোপে টিকল? কলেজ স্কোয়ার থেকে বেরুতে পারেনি। যারা খেয়েছিল সেসব যুবকের মধ্যে একজনও তো মাইকেল মধুসূদন দত্ত হতে পারেনি। উনবিংশ শতাব্দীতে যে উৎকট প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই সেদিন ধর্মতলায় যা ঘটল, তার সঙ্গেও তো সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। বিদেশে গিয়ে অনেক সময় বাধ্য হয়েছি খাদ্যাভ্যাস বদলাতে, মাছের ঝোল ভাতের সুযোগ যেখানে নেই সেখানে খিদে মেটাতে স্যান্ডুইচ, বার্গার খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেসব খাদ্যের বেশির ভাগই গো-মাংসের তৈরি। ‘খাব না’ বললে অভুক্ত থাকতে হবে। মজার কথা হলো যেহেতু সেই মাংস পাউরুটির আড়ালে থাকে তাই ‘কি খাচ্ছি’ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হয়নি। মনে আছে, পিটসবার্গ বিমানবন্দরের রেস্টুরেন্টে ভাত দেখে পাশের সসপ্যানে মাংসের লালচে ঝোল দেখে যখন জানতে পারলাম ওগুলো গরুর মাংস তখন হ্যাম স্যান্ডুইচ কিনে নিয়েছিলাম। এতকাল দেখা পাঁঠা বা মুরগির ঝোলের জায়গায় গরুর মাংসকে মেনে নিতে পারিনি। এই মেনে নিতে না পারা কোনো ধর্মের কারণে নয়, নিতান্তই অভ্যাসের ফল। না হলে স্যান্ডুইচে যা খেতে পারছি, ঝোলে তা পারছি না কেন?

এককালে দেখেছি কোনো মুসলমান সহপাঠী বাড়িতে এলে তাকে বাইরের ঘরে বসাতে হতো, তার জন্য বড় পিসিমা আলাদা গ্লাস বাটি রাখতেন। কেন? এর একটাই উত্তর শুনতাম, ওরা গরুর মাংস খায়। আমার পিসিমাকে কি ‘মৌলবাদী’ বলব? ঢাকায় এক পরিবারে আমি সাদরে নিমন্ত্রিত হয়ে দেখলাম টেবিলের এক কোনায় পাত্রে গো-মাংস আছে এবং তা আমাকে পরিবেশন করা হলো না, আমার অন্যান্য খাবার খেতে একটুও অসুবিধা হলো না। সেই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী কলকাতায় বেড়াতে এলে তাদের একটি নামি রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাছ-মুরগি অর্ডার দেওয়ার পর ভদ্র মহিলা জানতে চাইলেন, ওই রেস্টুরেন্টে শূয়রের মাংস রান্না করা হয় কিনা! উত্তরে ‘হ্যাঁ’ শুনে তৎক্ষণাৎ রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি স্বামীকে নিয়ে। ওই মহিলাকে কি ‘মৌলবাদী’ বলব? আমার এক মুসলমান বন্ধু ঢাকা থেকে চাকরির সুবাদে কলকাতায় এক বছরের জন্য এসেছিলেন। তার জন্য একটি ফ্ল্যাট খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিলাম। উত্তর কলকাতার কোনো বাড়িওয়ালা মুসলমান ভাড়াটে রাখতে রাজি হননি। অন্তত আমার জ্ঞানত নয়। তখন সল্টলেকে বা রাজারহাটে এত ফ্ল্যাট হয়নি। শেষ পর্যন্ত পার্ক সার্কাসে ওর জন্য ফ্ল্যাট পেয়েছিলাম। সেখানে বাস করার সময় বন্ধু অভিযোগ করেছিল, ‘তোমাদের ওই এলাকাটা আদৌ পরিষ্কার নয়।’ বন্ধু এ কথা বললেও, লক্ষ করেছি, বাংলাদেশ থেকে যারা কলকাতায় বেড়াতে আসেন, সেই মুসলমান ট্যুরিস্টরা ফ্রিস্কুল স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিট থেকে নিউমার্কেট এলাকায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মনে রাখতে হবে, ওইসব এলাকা এক সময় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের, পরে অবাঙালি মুসলমানদের দখলে ছিল। তথাকথিত হিন্দু বাঙালির গন্ধ না থাকা এলাকাটি মুসলমান ট্যুরিস্টদের পছন্দের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মৌলবাদের প্রচ্ছন্ন গন্ধ কি পাওয়া যায় না! আবার বলি, এটা ধর্মের কারণে নয়, স্রেফ অভ্যাসের বশে। তাই আমরা এই বঙ্গভ‚মিতে একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান গাই। ধর্ম তখন কণ্ঠরোধ করতে পারে না।  

ভারতবর্ষের মানুষ এতকাল দিলীপ কুমার-শাহরুখ খানদের অভিনেতা ছাড়া অন্য কোনো পরিচয়ে ভাবেনি, মহম্মদ রফি বা তালাত মামুদকে গায়ক হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে। আজ হঠাৎ যদি কেউ বলে, ‘ওরা মুসলমান’ তাহলে কি সেটাই মুখ্য হয়ে উঠবে? ভারতবর্ষের কিছু রাজ্যে ধর্ম নিয়ে যে অস্থিরতা কিছু রাজনৈতিক দল তৈরি করছে, তা অবিলম্বে শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। শাহরুখ খান এর প্রতিবাদ করেছেন শুনে তাকে ‘পাকিস্তানের চর’ বলে গায়ের জ্বালা মেটাতে হবে? এ অহেতুক আক্রমণ অবশ্যই নীচু মনের পরিচয় দিচ্ছে, যা অশিক্ষিত মানুষদের ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। অহেতুক এ বাড়াবাড়ি করার কী দরকার? পশ্চিম বাংলায় মানুষ যতটা ধর্মনিরপেক্ষ ততটা বোধহয় ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যের মানুষ নন।

সর্বশেষ খবর