রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া নূর হোসেন

মুখ খোলার আতঙ্কে অনেকেই

সাখাওয়াত কাওসার ও এম এ শাহীন

সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া নূর হোসেন

সাম্রাজ্য পুনরায় দখলে নিতে মরিয়া নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার অন্যতম আসামি নূর হোসেন। বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনার পর সাম্রাজ্যের বেশ কিছুটা বেদখল হয়ে গেলেও ইতিমধ্যে এর অনেকটা পুনরায় বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন নূর। ইতিমধ্যে হাতে এসেছে বালুমহাল ও হাজী বদরুদ্দীন মার্কেট। শিগগিরই শিমরাইলের সিনথিয়া মৎস্য খামারসহ সাম্রাজ্যের বাকি অংশগুলোও পুনরায় নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে বিশ্বাস নূরের সহযোগীদের। এরই মধ্যে এলাকায় খবর চাউর হয়েছে, কারাগারে বসে নিজের সাম্রাজ্য নিজেই মনিটর করবেন নূর, যা ভারতে বসে সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে নূর হোসেন মুখ খুলতে পারেন এমন আতঙ্কে ভুগছেন অনেকেই। তবে নূরের নিরাপত্তায় একজন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন বলে দাবি করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদালতে তোলার আগ পর্যন্ত এরই মধ্যে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় নিজের অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখা গেছে। অনেকটা দম্ভোক্তির সুরে কর্মকর্তাদের নূর বলেন, ‘স্যার, কয়দিন আমারে আটকাইয়া রাখবেন? বেশি হইলে চাইর বছর! হের পরে তো কোনোভাবেই আমারে রাখতে পারবেন না। আমার টাকা কার পেটে না গেছে স্যার!’ এর আগে ২ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে নূর হোসেন মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক হাসানই কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে সিদ্ধিরগঞ্জের ট্রাকস্ট্যান্ডে নূর হোসেনের অফিস পুনরায় দখলে নিতে গিয়েছেন স্বয়ং আরিফুল হক ও নূরের ভাতিজা শাহজালাল বাদল। তবে পুলিশি বাধায় তখন তা সম্ভব হয়নি। উপ-নির্বাচনের আগে কলকাতার আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নূর হোসেন সদম্ভে বলেছিলেন, ‘আমার মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করার কোনো শক্তি নারায়ণগঞ্জে নাই।’ সিদ্ধিরগঞ্জের অনেকেই মনে করছেন, কাউন্সিলর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নূর হোসেনের সাম্রাজ্য তার আত্মীয়স্বজন ও সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। বালুসাম্রাজ্য, মাদকসাম্রাজ্য, তেলসাম্রাজ্য, জবরদখলদারি, টেন্ডারবাজি- সবই এখন নূর হোসেনের সিন্ডিকেটের দখলে। শুধু পরিবহন সেক্টরের একটি অংশ এখনো নিজ আওতার বাইরে রয়েছে। একই সঙ্গে নূর মুখ খুললে অনেকেই ফেঁসে যেতে পারেন। তাদের অনেকেই প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে ভুগছেন। তারা কখনো চাননি নূর দেশে ফিরুক।

যদিও নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা কোনো ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড বরদাশত করব না। এলাকায় শান্তির পরিবেশ থাকবে এটি যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করা হবে।’ তবে নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি শুক্রবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘নূর দেশে আইছে। হেরে রিমান্ডে নেওয়া হইল না। আমি আমার পোলা-মাইয়ারে নিয়া আতঙ্কে আছি। ইয়াসিনসহ পাঁচজনরে চার্জশিট থাইক্যা বাদ দেওয়া হইছে। এইবার হে যে কী করব আল্লাহই জানে। হের ক্যাডাররা আরও আগে থাইক্যাই এলাকায় আইয়্যা পড়ছে।’ একই কথা বলছিলেন নিহত লিটনের ভাই মিন্টু ও নজরুলের ভাই সালাম। গত বছরের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সাতজনের লাশ উদ্ধার হয়। আলোচিত এই খুনের ঘটনার পর নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা পালিয়ে যায়। অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে গ্রেফতারের পর নূর হোসেনের অবৈধ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

সূত্র জানায়, স্থানীয় যুবলীগ নেতা মনিরুল ইসলাম মনিরের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট নূরের সাম্রাজ্য দখলে নিয়ে নেয়। প্রথমেই দখলে নেয় শিমরাইলে ৫০ একর জমির ওপর সিনথিয়া মৎস্য খামার। পরে ট্রাকস্ট্যান্ড, বালুমহাল, পরিবহন ব্যবসা। স্থানীয় সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দীন ভাগ বসানোর চেষ্টা করেন হাজী বদরুদ্দীন মার্কেটে। হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হাসান ও বাদলের নেতৃত্বে আসলাম, সুরুজ, লিটন, বাপ্পী, সেলিম খান, মাসুম, রতন, ভাঙ্গারি নবী, বেকারি আলম, রিপন, শাহ আলম এলাকায় পুরোদমে সক্রিয় রয়েছেন।

সরেজমিন সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত নূর হোসেনের অপরাধ সিন্ডিকেটের কোনো সদস্যকে এলাকায় দেখা যায়নি। তবে ৮ এপ্রিল আলোচিত সাত খুনের দুটি মামলার ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। নূর হোসেনের খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এলাকায় ফিরতে শুরু করে। পুনরায় দখল নিতে থাকে নূরের হারানো সাম্রাজ্য। আগে যে যেখানে ছিল তা দখল করে নেয়। নূর হোসেনের ভাই নুরুজ্জামান জজ এলাকায় ফিরেই কাঁচপুর ব্রিজের ঢালে সড়ক ও জনপথের (সওজ) জায়গা দখল করে। দেড় শতাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সে সওজের জায়গা দখল করে সেখানে বালু ভরাট করে চলেছে। সেখানে ‘মেসার্স জেরিন ট্রেডার্র্সের সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। শিমরাইলে ৫০ একর জায়গার ওপর নূরের মেয়ে সিনথিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত মৎস্য খামারটিও প্রথমে মনির দখল করে নেয়। পরে নূরের সহযোগী বাদল পুনর্দখলে নিয়েছে। যদিও ওই খামারে এখন পর্যন্ত মাছের পোনা ছাড়তে সক্ষম হয়নি তারা।

নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল ঈদের তিন দিন আগে এলাকায় ফিরেছেন। অস্ত্রসহ তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা রয়েছে। এলাকায় ফিরেই তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর স্থাপিত বাস কাউন্টার ও ফুটপাথ দখল করেন। নূরের ভাতিজা আনু এলাকায় ফিরে লেগুনা ও টেম্পোস্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন। সেখানে ৩০০ লেগুনা থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে আনুর লোকজন। নূরে হোসেনের দূর সম্পর্কের ভগ্নিপতি রতন মোল্লা ফিরে এসে পরিবহন সেক্টরের দখল নিয়েছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, একটা বিশাল বাহনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই রতন মোল্লা।

নূরের নিরাপত্তায় এক কারারক্ষী : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘শাপলা সেলে’ নূরের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিকভাবে একজন কারারক্ষী মোতায়েন রাখা হয়েছে। সেলের সামনের বারান্দা ও পাশের রাস্তাটি সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন এক কারা কর্মকর্তা। এ ছাড়া গতকাল কোনো স্বজন কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে যাননি। পারসোনাল ক্যাশে (পিসি) কোনো টাকা জমা হয়নি বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর