শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

প্যারিস হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় শরণার্থীরাই

আমীর খসরু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে চলতি বছরের মতো এত বিশাল সংখ্যায় মানুষ আগে আর কখনোই শরণার্থী হয়নি, ঘটেনি উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনা। একযোগে এত দেশে ছোট কিংবা বড় যুদ্ধের ঘটনাই আর একসঙ্গে কোনো দিন দেখা যায়নি। জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন, মানব জাতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে। এই যুদ্ধ কেন হচ্ছে তার ব্যাখ্যা অবশ্য এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, তারা যুদ্ধ আর আক্রমণ করছে কথিত ‘আদর্শ’ প্রতিষ্ঠার জন্য। আবার ওই কথিত আদর্শের বিপরীতে অন্যরা যুদ্ধে লিপ্ত। তবে সবচেয়ে বড় বাস্তব ঘটনাটি যা ঘটছে তা হচ্ছে- তেল ও অস্ত্র বিক্রির বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে। তেলের জন্য যুদ্ধ সেই চলি­শের দশক থেকে এখন পর্যন্ত পুরোদমে চলছে, বরং বেশি মাত্রায়ই। এন্থনি স্যামসন তার দ্য সেভেন সিস্টারস  গ্রন্থে তেল কোম্পানি এবং রাষ্ট্রগুলো কীভাবে তেলের জন্য লড়াই বাধিয়ে দেয় আর যুদ্ধ সৃষ্টি করে, নানা কৌশলের আশ্রয় নেয় তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন দুই দশক আগে। যুদ্ধ বরাবরই স্বল্প সংখ্যকের জন্য অতিমাত্রায় লাভজনক ব্যবসা হলেও অধিকাংশ মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যই ডেকে আনে। এ দুর্ভাগ্যেরই অনিবার্য ফলাফল দেশহীন উদ্বাস্তু, শরণার্থী। সিরিয়ার তিন বছরের ছোট্ট শিশু আয়লান কুর্দির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। আয়লান কুর্দির বাবা-মা যুদ্ধের ভয়াবহতায় দেশান্তরী হতে চেয়েছিলেন। আর সে কারণেই সমুদ্রে নৌকাডুবির ঘটনায় আয়নালের মৃতদেহটি পড়েছিল তুরস্কের উপকূলে। ঘটনাটি ঘটে এ বছরেরই ২ সেপ্টেম্বর। তার স্থিরচিত্রটি প্রকাশের পর অভিবাসন বিষয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কঠিন-কঠোর নীতি বিশ্ব জনমতের চাপে শিথিল করতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫’র জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ইউরোপের দেশগুলোর সীমান্তে কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ অভিবাসন প্রত্যাশী জড়ো হয়েছিলেন। অথচ ২০১৪ সালে সারা বছরে বিশ্বজুড়ে এই সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার। আইওএম যে হিসাব দিয়েছিল তাতে দেখা যায়, গ্রিস কিংবা ইতালিতে পৌঁছানোর চেষ্টায় ওই সময়কালে ২ হাজার ৬০০ জন অভিবাসন প্রত্যাশী ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন। ২০১৪ এবং এ বছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ দেড় বছরে ভূমধ্যসাগরেই ডুবে মারা গেছেন ৫ হাজার ৩৫০ জন। আর গত ১৫ বছরে ওই স্থানেই মারা গেছেন ২২ হাজার ৪০০ অভিবাসন প্রত্যাশী। এই সংখ্যা পরবর্তীকালে বেড়েছে। শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনএইচসিআর যে তথ্য দিয়েছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। ইউএনএইচসিআর বলছে, তীব্র শীত উপেক্ষা করে গত কিছু দিনে প্রতি মাসে আড়াই লাখ অর্থাৎ প্রতিদিন ৮ হাজারের বেশি মানুষ ইউরোপের দিকে ছুটছেন এবং পৌঁছে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তবে আইওএম বলছে, ২০১৫ সালেই ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন এমন অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা লক্ষাধিক।

গ্লোবাল ট্রেন্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তুর সংখ্যা পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ। অথচ মাত্র এক বছর আগে ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল এক কোটি ৯৫ লাখ, যা আগের বছর ছিল এর চেয়ে ২৯ লাখ কম। জাতিসংঘ ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর হিসাব মতে, নির্যাতন থেকে বাঁচতে এখন প্রতিদিন গড়ে ৪২ হাজার ৫০০ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়ছে। সবাই যে সীমান্ত অতিক্রম করছে, তা-ও নয়, অনেকে দেশের ভিতরেই কোথাও গিয়ে আশ্রয় খুঁজছে। ইউএনএইচসিআর গত বছরই যে হিসাব দিয়েছিল তাতে দেখা যায়, ওই সময় বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি। এরা উদ্বাস্তু হয়েছেন যুদ্ধের ভয়াবহতায়। এ সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে দেশত্যাগ করছেন সিরিয়া থেকে। এক কোটি ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন, উদ্বাস্তু হয়েছেন ওই দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে। এদের ৪০ লাখ পৌঁছেছেন তুরস্ক, লেবানন ও জর্ডানে। আর সাত লাখ চলে গেছেন ইউরোপে অভিবাসী হওয়ার জন্য। ইরাকে ২০১৪ সালেই বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন ২২ লাখ। ইউক্রেন থেকেও মানুষ ছুটছে বিভিন্ন দেশে। এই সংখ্যা কম করে হলেও ছয় লাখ ৪০ হাজার। এ ছাড়া এ তালিকায় রয়েছে লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশ। ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট সেন্টার বলছে, বাস্তুচ্যুতির কারণে সামগ্রিক অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। কম করে হলেও ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে বর্তমানে এ বাবদ। গ্লোবাল পিস ইনডেস্ক, অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ইকনোমিক্স অ্যান্ড পিস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, øায়ুযুদ্ধের পরে যেমনটা প্রত্যাশা ছিল অর্থাৎ শান্তিময় হবে বিশ্ব তা হয়নি। বরং গত আট বছরে বিশ্বজুড়ে অশান্তিই বিরাজ করছে।

এই যখন সামগ্রিক পরিস্থিতি তখন প্যারিসের জঙ্গি হামলা পুরো পরিস্থিতিকেই আবার পাল্টে দিয়েছে। প্যারিস হামলায় কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায়, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শরণার্থীরা। বিশেষ করে ইউরোপে পৌঁছে যাওয়া শরণার্থীরা। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী নিদারুণ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। তাদের আতঙ্ক, শঙ্কা অনেক অনেক বেশি মানসিক। ইতিমধ্যে অভিবাসন নীতিতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পরিবর্তন আনার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একাংশের মোটামুটি মনোভাব হচ্ছে, আর অভিবাসী গ্রহণ নয়। বিশেষ করে মুসলিম দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীরাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জার্মানি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। সেই জার্মানিই এখন পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে তাদের নীতিতে। ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের মনোভাব কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। ইউরোপজুড়ে ইতিমধ্যেই সরকার প্রধান, সরকারের কর্তাব্যক্তি এবং রাজনীতিকরা অভিবাসন প্রত্যাশীদের যাতে অভিবাসন দেওয়া না হয় সেজন্য নানা কথা বলছেন। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে কোটা ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছিল অভিবাসীদের আশ্রয়ের জন্য, তা তারা মানবেন না। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অভিবাসী হয়ে জঙ্গিরাই সুযোগ নিচ্ছে এবং ইউরোপজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। শুধু যে সরকারি পর্যায়ে বা রাজনীতিকদের কাছ থেকে এমন বক্তব্য আসছে তা-ই নয়, উগ্র ডানপন্থার উত্থান ঘটছে ইউরোপজুড়ে। ইউরোপের উগ্র ডানপন্থিরা যেমন ফ্রান্সের লে ফ্রন্ট ন্যাশনাল, ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পার্টি বা ইউকেআইপি, নেদারল্যান্ডসের পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম অ্যান্ড ডেমোক্রেসিসহ বিভিন্ন উগ্র ও ডান সংগঠন এখন প্রকাশ্যেই ‘অভিবাসন হটাও’ বলছে। আর এতে অসহায়, শঙ্কিত, আতঙ্কিত এবং বিপন্নবোধ করছেন আগে থেকে যাওয়া অভিবাসীরা এবং তারচেয়ে অনেক গুণে বেশি সদ্য যারা পৌঁছেছেন সেসব শরণার্থী।

ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্সের জ্যেষ্ঠ গবেষক ব্র“নো টার্টিজ বলছেন, আমার আশঙ্কা, ক্রমবর্ধমান হারে যে শরণার্থী আসছে তাদের জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে খুবই মর্মান্তিক এবং অযৌক্তিক একটি কাজ। যুদ্ধ তা যে পক্ষেরই হোক না কেন, তা তাদের জন্য লাভজনক। কিন্তু ক্ষতির কারণ হয় সাধারণ মানুষের। পক্ষ-বিপক্ষ মিলিয়ে সবাই এখন তেল সম্পদ, অস্ত্র বিক্রিসহ বৃহৎ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এমনকি আইএসও তেল সম্পদসহ বৃহৎ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে, প্যারিস হামলায় মূল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসহায় শরণার্থীরা। আর যুদ্ধে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা অতীতে যেমন হয়েছে এবং বর্তমানেও তাই হচ্ছে।

(আমীর খসরু, সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম)

সর্বশেষ খবর