সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
সংসদে এমপিদের উচ্ছ্বাস

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের    ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বস্তি প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে গতকাল সংসদেও সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এ দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘিরে দেশে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করে গোয়েন্দারা একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। পরে তারা এই প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট সব দফতরে পাঠায়। প্রতিবেদনের সম্ভাব্য নাশকতার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা   বাহিনী তা মোকাবিলায় কার্যকরী একটি ছক তৈরি করে। সে অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন করা হয় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের মধ্যে। এদিকে গতকাল সংসদে সন্তোষ প্রকাশ করে ত্রাণমন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, দুজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। আজকে মহান সংসদে দাঁড়িয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষকে চিৎকার করে বলতে চাই, শেখ হাসিনা থাকলে বাংলাদেশে কোনো রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কোনো দিন এই দেশে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বিচার শুরু হয়েছে, বিচার শেষ হবে। সূত্রে জানা যায়, বিগত সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের রায় ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালায় জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা। সে কারণে এবার রায় কার্যকরের আগে থেকেই সারা দেশে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। যে কারণেই এবার দেশের কোথাও কোনো নাশকতা চালাতে পারেনি জামায়াত-শিবির ও তাদের মিত্ররা। এ ছাড়াও সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগও সারা দেশে সতর্ক ছিল। যেখানেই নাশকতার চেষ্টা সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সব ধরনের প্রস্তুতি রেখেছিল বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রায় কার্যকরকে ঘিরে জামায়াত-শিবির সারা দেশে বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে নাশকতা করার ছক তৈরি করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগেই সতর্ক থাকায় তাদের সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, ফাঁসিতে ঝুলানো নেতাদের একজন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও আরেকজন বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য এবং এক সময়ে তার চট্টগ্রামে বেশ দাপট ছিল। সে কারণে আমরা সতর্ক ছিলাম যেন কোনো ধরনের নাশকতা করতে না পারে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, সরকারের দায়িত্ব দেশের নাগরিককে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর রায়কে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক ছিল। যে কারণে দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর কোথাও নাশকতা করতে পারেনি। দেশের মানুষও শান্তিতে আছে, সরকারও স্বস্তি পেয়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, এ শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষণার পর থেকেই রায় বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে। দেশের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলা-এমনকি বিদেশিদের হত্যা ও গুপ্তহত্যা চালানো হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারের দৃঢ়্যতা ছিল যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকর করতে। ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই টানা চার রাত ঘুমাতে পারি নাই। কীভাবে ঘুমাই বলেন? যদিও কোনো কিছু হয়ে যায়? বিএনপি আর জামায়াতের এই দুজনের সমর্থকরা যদি কোনো কিছু ঘটাইয়া ফালায়? সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজারো  শোকর যে কোনো কিছু হয়নি।’ শুধু পুলিশের এই কর্মকর্তা নয়, বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের মন্তব্যও একই রকম। আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১৩ সালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় হওয়ার পর থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে দারুণ মানসিক চাপে ছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। আপিল বিভাগে রায় বহাল ও সর্বশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্বিগ্নতার মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়। কখন কী হয়। মূলত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে আদাজল খেয়ে নামে গোয়েন্দারা। প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে সারা দেশে শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে নেওয়া হয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও এর আশপাশের এলাকা। সতর্কতার অংশ হিসেবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হয় চেকপোস্ট। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের কাজই হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে জননিরাপত্তা দেওয়া। আমাদের চাকরির ন্যাচারই এটা। মাঝে-মাঝেই বড় বড় ইভেন্ট আসে আর ঢাকা মহানগর পুলিশ সেগুলো দক্ষতা এবং সফলতার সঙ্গেই পার করছে। পুলিশ সদস্যরা কখনোই স্বস্তিতে থাকতে পারে না।

সংসদে এমপিদের উচ্ছ্বাস : দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় জাতীয় সংসদে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব আনা হয়। এমপিরা নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, এই ফাঁসির রায় কার্যকরে গোটা জাতির সঙ্গে আমরাও সন্তুষ্ট এবং আনন্দে আÍহারা। এই রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতির ৪৪ বছরের কলঙ্কমুক্তি আরেক ধাপ এগিয়ে গেল।    

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল বিকালে অধিবেশন শুরু হলে প্রশ্নোত্তর পর্বে নির্ধারিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীরবিক্রম) বলেন, আমি আজ আনন্দে আÍহারা। সারা দেশের মানুষ কেউ শনিবার রাতে ঘুমাননি। ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা টেলিভিশনের সামনে বসেছিলেন। মন্ত্রী বলেন, এটি একমাত্র সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জন্য। আজ সব মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই। বীর মুক্তিযোদ্ধা মায়া বলেন, আজ মহান সংসদে দাঁড়িয়ে সারা দেশের মানুষকে চিৎকার করে বলতে চাই, শেখ হাসিনা থাকলে বাংলাদেশে কোনো রাজাকার, আলবদর, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কখনো মাথাচাড়া দিতে পারবে না। চট্টগ্রামের এমপি নজরুল ইসলাম চৌধুরী সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেন, আজ চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশের মানুষ খুশিতে আÍহারা। আমরা খুশি। সরকারদলীয় সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন উত্থাপনকালে দুই যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকরের বিষয়টি সামনে এনে বলেন, আজ সারা দেশে ‘শাবাশ, শাবাশ’ বলে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

 সরকারি দলের এ কে এম শাহাজাহান কামাল আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে বলেন, কেবল বাংলাদেশের মানুষ নয়, দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় সারাবিশ্বের বাঙালিরা আনন্দিত, উচ্ছ্বাসিত। একমাত্র শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।

সর্বশেষ খবর