শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্যাংক লুটে কৌশল বদল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংক লুটে কৌশল বদল

ভুয়া ও বেনামি ঋণে খালি হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুশাসনের কড়া বার্তা দিলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ব্যাংকিং খাতের এই লুটপাট। পুরো ব্যাংকিং খাতেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে লুটেরা এই সিন্ডিকেট। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই নয়, বেসরকারি ব্যাংকও খালি হয়ে যাচ্ছে এই লুটেরাদের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোতে ভুয়া এফডিআর খুলে তা দিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ভুয়া ডকুমেন্ট ও ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে কোটি কোটি টাকা নিয়ে মেরে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে গত তিন বছরে এমন প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা রাইট অফ (অবলোপন) করেছে। অবলোপনকৃত তথ্য চাইলেও জরিমানা আর সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তা সরবরাহ করছে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। রাঘব-বোয়ালদের সঙ্গে এই লুটপাটে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরাও জড়িত বলে জানা গেছে। ব্যাংক মালিক ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নিজেরাই ভুয়া সার্টিফিকেট, এফডিআর সনদ তৈরি করতে এবং নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের টাকা লোপাট করতে সহায়তা করছেন বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাঘব-বোয়ালদের আটকাতে না পারলে অবলোপনের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। গত কয়েক বছরে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমান হু হু করে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দুই বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি গায়েব হয়ে গেছে। মন্দ ঋণের নামে ব্যাংকগুলো এ টাকা অবলোপন করেছে। ব্যাংকিং খাতে মন্দ  হিসেবে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সর্বশেষ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো একটি ব্যাংকের ভুয়া এফডিআর সার্টিফিকেট তৈরি করে ভিন্ন আরেকটি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে ওই এফডিআর সার্টিফিকেটের বিপরীতে। ব্যাংকগুলো এফডিআর সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই না করে ঋণ অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে। ঋণ দেওয়ার কয়েক বছর পর দেখা যাচ্ছে, যে সার্টিফিকেটের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ ভুয়া। এ ছাড়া সম্পূর্ণ ভুয়া কোম্পানি গঠন করে জাল দলিল জমা নিয়েও ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এসব ভুয়া দলিল রেখে ঋণ দেওয়ার পর ফেঁসে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। তখন দেখা যায়, যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ওই ঠিকানায় কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড থাকলেও যে দলিল দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি জাল। এমনকি ঋণগ্রহীতার নাম পর্যন্ত ভুল। তখন ব্যাংকগুলো তাদের ভালো রেপুটেশন ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে ওই ঋণ সবই অবলোপন করে দেয়। একবার অবলোপন করে দিলে সে ঋণ আর কখনোই ফেরত পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করে দেয় আর তা বছরের পর বছর চলতে থাকে। ঋণ নেওয়া ব্যক্তিকেই আর খুঁজে পায় না ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব ব্যাংকের কাছে ঋণের তথ্য চাইলে তারা নানাভাবে গোঁজামিল দিয়ে তথ্য দেয়। সঠিক কোনো তথ্য তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেও দেয় না। অনেক সময় শাস্তি এড়াতে ব্যাংকগুলো মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

এসব অনিয়ম-জালিয়াতিতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরাও জড়িত। এমনকি জড়িত বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন করে মালিক রয়েছেন, যারা ভুয়া এফডিআর গ্রহণ করে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে আÍসাৎ করছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের একজন মালিক হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ভিন্ন পরিবার থেকে পরিচালক নিয়োগ দিতে হয়। তবে নিজের আÍীয়স্বজন, অনেক ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে দেখানো হয়, যারা ওই ব্যাংকের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন। বছরের পর বছর নিজ মালিকানায় বেসরকারি ব্যাংকের এই মালিকরা ইচ্ছামতো জালিয়াতি-অনিয়ম করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে অবলোপন ঋণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। পরবর্তী তিন বছরে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত অবলোপন করা হয়েছে আরও প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকসহ বিশেষায়িত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাইট অফ বা অবলোপন একটি বৈধ প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের দেশে এর অপব্যবহার হয়। ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্সশিট পরিষ্কার রাখতে এ প্রথা বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে যে ঋণগুলোকে অবলোপন দেখানো হয়, সেগুলো আর ব্যালেন্সশিটে থাকে না। অন্য এক জায়গায় নোট দিয়ে দেখানো হয়।’ এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি আরও উৎসাহিত হয় বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর। এ ছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাংকিং খাতে অনেক সময় ঋণ অবলোপনের হার বাড়ে, যা এ খাতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকগুলোর তদারকি বাড়াতে হবে। ঋণ দেওয়ার আগে তা যাচাই করতে হবে। তাহলেই সম্ভব ব্যাংকিং খাতে অবলোপন ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ঋণ মন্দ হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা আদায় করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অবলোপন করতেই ব্যাংকের আগ্রহ বেশি। এর সঙ্গে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাই জড়িত। গত কয়েক বছরে অবলোপনের হার কেন বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। একই সঙ্গে আর যেন এমনভাবে অবলোপন করা না হয় সেদিকে নজর রাখা উচিত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর