শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

হতবিহ্বল থমথমে বগুড়া

হামলায় অংশ নেয় তিন যুবক, মামলা আটক ২

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

হতবিহ্বল থমথমে বগুড়া

বগুড়ায় মসজিদে নিহত মুয়াজ্জিনের স্বজনদের আহাজারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরের চককানু গ্রামের শিয়া মসজিদে দুর্বৃত্তদের গুলিতে হতাহতের পর পুরো এলাকা থমথমে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন স্থানীয় জনগণ। শুক্রবার জুমার নামাজ হয়নি আল মোস্তফা শিয়া মসজিদে। মসজিদ এলাকায় বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা। গুলিবর্ষণের শিকার মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জিম হোসেনকে (৬৮) মসজিদের সামনে ফাঁকা জায়গায় গতকাল বিকালে দাফন করা হয়েছে। আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতেই শিবগঞ্জ থানায় মসজিদের মুসল্লি সোনা মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে আটক করেছে। ঘটনাস্থল ঘুরে স্থানীয় জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল রাস্তা থেকে গলিপথে ঢুকে কিছু দূর এগিয়ে গেলেই আল মোস্তফা মসজিদের অবস্থান। মসজিদে প্রবেশের তিনটি কাঠের দরজা থাকলেও সার্বক্ষণিক খোলা থাকে দক্ষিণ পাশের একটি দরজা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় এ দরজা দিয়ে এসেই শিয়া মসজিদে মাগরিবের নামাজ ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করার জন্য মুসল্লিরা একত্রিত হয়েছিলেন। মসজিদের দুই পাশে চারটি করে মোট আটটি জানালা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে এশার নামাজের আগে যখন ১৫-২০ জন মুসল্লি দোয়া দরুদ পড়ছিলেন ঠিক তখনই খোলা দরজা থেকে গুলি চালায় তিন যুবক। যুবকদের আনুমানিক বয়স ২০ থেকে ২২ বছর। গুলি করার পর যুবকরা দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রাচীর টপকে পালিয়ে যায়। উপস্থিত মুসল্লিরা তখন জীবন বাঁচাতে মসজিদের ভিতরে দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। রক্তাক্ত মোয়াজ্জিম হোসেন, শাহীনুর রহমান, আবু তাহের ও আফতাব উদ্দিনসহ অন্যরা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেই রক্ত মসজিদের মেঝেতে এখনো ছড়িয়ে আছে। পিলারে রয়েছে পাঁচটি গুলির চিহ্ন। জানা যায়, গতকাল সকাল ৮টা থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি ফরেনসিক দল আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। মসজিদ থেকে ৮টি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে শিয়া মসজিদে মুসল্লি ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে। শিয়া মাজহাবের অনুসারীরা গতকাল নামাজ আদায় করেছেন মসজিদ পরিচালনা কমিটির গড়া বাংলাদেশ ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনে। ফাউন্ডেশনের অর্থবিষয়ক সম্পাদক শাহিনুর রহমান জানান, শিয়া মাজহাবের অনুসারী ১১০টি পরিবার এখানে বাস করে। ফাউন্ডেশনের কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। শুরুতে এর নাম ছিল ইমামিয়া পাঠচক্র। পরে বাংলাদেশ ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন নাম রাখা হয় এবং ২০১৩ সালে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন ঘরে সেবামূলক সেলাই প্রশিক্ষণ, কোরআন শিক্ষা প্রদান করা হয়। শিয়া এবং সুন্নি উভয় পরিবারের সদস্যরা এই সেবা পেয়ে থাকেন। ঘরে আরবি লেখা বিভিন্ন প্লাকার্ড, বই, একটি টেলিভিশন এবং ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও ইমাম খোমেনির ছবি টানানো রয়েছে। ফাউন্ডেশনের আওতায় শিয়া মসজিদ পরিচালিত হয়ে থাকে। মসজিদটি ২০০৩ সালে ছিল টিনশেড, ২০০৬ সালে একতলা ভবন হয়েছে। শাহীনুর রহমান আরও জানান, ১৯৮২ সালে শিয়া মাজহাব নিয়ে কাজ শুরু হয়। শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মাজহারের সূচনা করেন আলহাজ আবু জাফর মণ্ডল। আবু জাফর মণ্ডলের পিতা রহিম উদ্দিন মণ্ডল (মরহুম) ছিলেন সুন্নি মাজহাবের। আবু জাফর মণ্ডল জানান, ঢাকায় ইরানি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকায় তিনিই প্রথম শিয়া মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরে এলাকার আরও অনেকে শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেন। এই মসজিদ কেন্দ্র করে ১১০ জন শিয়া মতাদর্শী রয়েছেন, যাদের বসবাস মূলত কিচক ইউনিয়নের হরিপুর, চল্লিশছত্র, আলাদিপুর, গোপীনাথপুর, রামকান্দি ও বেলাইল গ্রামে। এই আল মোস্তফা মসজিদে তারা নামাজ আদায় করেন। এ ছাড়া পাশের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পানিতলা, কানদিয়া, বড়িপাড়া ও খড়পা এলাকায়ও শিয়াদের বসবাস রয়েছে। তারা জিয়ারতের সময় আল মোস্তফা মসজিদে আসেন। গুলিতে নিহত মোয়াজ্জিমের শ্যালক শহিদুল ইসলাম জানান, মোয়াজ্জিমের চার ভাইয়ের মধ্যে শুধু মোয়াজ্জিম শিয়া অনুসারী। বাকিরা এখনো সুন্নি। তার এক ছেলে ও  এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে শাহাজুল ইসলাম টাঙ্গাইলের ইটভাটায় সর্দার পদে কর্মরত। খবর পেয়ে রাতেই ছেলে বাড়ি পৌঁছেছে। তিনি জানান, বিকাল ৩টায় মোয়াজ্জিম হোসেনের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে। পুত্র শাহাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে। বাবা খোঁজখবর নিয়ে নিয়মিত নামাজ আদায় করার পরামর্শ দেন। আর সন্ধ্যার পর জানলাম বাবা গুলিতে মারা গেছেন। নিহত মোয়াজ্জিমের চাচা উকিল মিয়া জানান, এলাকায় সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।  কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা অনুমান করা কঠিন। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শত শত মানুষ সমবেদনা জানাতে মোয়াজ্জিম হোসেনের বাড়িতে এসেছেন। তারা অনেকে সকাল থেকেই ভিড় করে। শিয়া মসজিদ আল মোস্তফায়ও ভিড়। মসজিদের দুই পাশেই শিয়া ও সুন্নি মতাদর্শের ১৩০টি পরিবারের পাঁচ শতাধিক লোকের বাস। বগুড়া শিবগঞ্জের অফিসার ইনচার্জ আহসান হাবীব জানান, শিয়া মসজিদে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুলিবর্ষণের পর থেকে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। হামলাকারীরা কী উদ্দেশ্যে এ হামলা চালিয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। ময়নাতদন্ত শেষে মোয়াজ্জিম হোসেনের লাশ শুক্রবার দুপুরে পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়া হয়েছে। বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিবগঞ্জের মাঝিহট্ট ইউনিয়নের সৈয়দ দামগড়া গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৫৫) ও আটমূল ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে জুয়েলকে (২০) থানায় নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বিকালে রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৮টি গুলির খোসা উদ্ধার করেছে। ঘটনাস্থল ও শিয়া সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বগুড়া পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান জানান, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ঘটনার সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত  নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর