শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

একটুও ঠকবেন না পুরো তৃপ্তি পাবেন

সমরেশ মজুমদার

একটুও ঠকবেন না পুরো তৃপ্তি পাবেন

ইদানীং অনেকেই বলছেন, আর খবরের কাগজ পড়া যাচ্ছে না। সকালের কাগজে হাত দিতে গেলে ভয় লাগে, আবার কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা পড়তে হবে। এসব ঘটনা পড়ার পর নার্ভ ঠিক থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। এই যেমন প্রথম পাতায় ইন্দ্রাণীর ক্রিয়াকলাপ, যা আমাদের যাবতীয় ভাবনাচিন্তাকে অকেজো করে দিচ্ছে, তার বিস্তৃত বিবরণ, একটু নিচে দুর্গাপুরের এক ব্যাংক ম্যানেজার নির্লিপ্ত মুখে তার প্রেমিকা এবং প্রেমিকার সন্তানকে শুধু খুন করছেই না, তাদের দেহ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলছে। সাংবাদিকরা এসব লেখার সময় যত বিশদে যান, পাঠক হিসেবে ততই আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। যেদিন খবরটা হলো, সেদিন কাগজে ছেপেই সম্পাদক থেমে গেলেন না। তদন্ত কিভাবে চলছে তা জানানোর নৈতিক দায়িত্ব আছে মনে করে প্রতিদিন একটু একটু করে সেটা ছেপে চলেছেন। পড়তে গিয়ে শিউরে উঠছি, চোখ সরাতেই চোখ পড়ছে, ছাত্রীর উপর বলাৎকারের প্রতিবাদে আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পাতা খুললেই পড়ছি মন্ত্রী এমন সব কথা বলছেন, যা সৌজন্যবোধের সীমা অতিক্রম করছে। মন খারাপ হয়। ভাবি খেলার পাতায় চলে গেলে মন এসব থেকে বাইরে থাকবে। হায় কপাল, খেলার পাতায় ছবি ছাপা হয়েছে পরাজিত দলের এক খেলোয়াড় রেফারিকে মারতে উদ্যত হয়েছেন। বিরক্ত হয়ে মাঝের পাতা খুলি। পাতাজুড়ে জাপানি তেলের বিজ্ঞাপন। না দেখার ভান করে চোখ সরাতে গিয়ে নাতির গলা শুনে মুখ ফেরান দাদু। চার বছরের নাতি আবদারের গলায় বলে, ‘দেখি দেখি, আজও কাগজে দিয়েছে। দেখো না দাদু, বাবাকে কত করে বলেছি জাপানি তেল কিনে আনতে, আনছে না। তুমি নিয়ে এসো না দাদু। ওই তেল মাখলে সাপ কখনোই কামড়ায় না। স্কুলের বন্ধুরা বলছিল।’ দাদু কাগজ বন্ধ করলেন। টিভিতে খবর শোনার অভ্যাস এখন ছাড়তে হচ্ছে। বেশ চলছিল, কোনো এক ইস্যু নিয়ে বিস্তর উত্তেজিত কথাবার্তা। পাঁচজন আলোচকের মধ্যে, একজন থাকবেন, যিনি সরকার পক্ষের অন্ধভক্ত। তার কথাবার্তা হাস্যরসের উদ্রেক করে বলেই বোধহয় তিনি আমন্ত্রিত হন। হঠাৎ সঞ্চালক বিজ্ঞাপন বিরতি ঘোষণা করেন। চট করে রিমোট টিপে চ্যানেল পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেন দাদু। কিছু না হোক ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। ওই বিজ্ঞাপন বিরতিতে সেই বোনের গলা বেজে উঠতে পারে, ‘অ্যাই দিদি...’! কোনো কর্মের কারণে সপ্তাহে কয়েকবার খাট সারাতে হয়, তা পাশে বসা কিশোর নাতির মুখ দেখে বুঝতে পারা যায় না সে জানে কি না! দাদুকেও উদাস চোখে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এর সঙ্গে সমস্যা বাড়িয়েছে খবরের কাগজ। তারা বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার খবর বিস্তৃতভাবে লিখছিল এবং লিখছে যাতে ক্রাইম থ্রিলার পড়ার আনন্দ পাঠকরা পরিপূর্ণভাবে পান। সেই সঙ্গে আধখানা পাতাজুড়ে ‘বান্ধবী চাই’- এর বিজ্ঞাপন ছাপছেন। প্রথমদিকে বিজ্ঞাপনগুলো বেশ নিরামিষ ছিল। ক্রমশ প্রশ্রয় পেয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের সাহস বাড়ল। ‘একটুও ঠকবেন না’, ‘পুরোপুরি তৃপ্তি পাবেন’... ইত্যাদির সঙ্গে বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে প্রচুর রোজগার করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। সেটা কিভাবে সম্ভব, তা বুঝতে পারেন না অনেকেই। আমার পরিচিত এক অধ্যাপককে তার ছেলে বলেছিল, ‘বাবা খোঁজ নিয়ে দেখ তো ওরা কি কাজ করার জন্য টাকা দিতে চাইছে আর কত টাকা দেবে?’ আমাদের কারও কিছু করার নেই। যে কোনো ছুতো পেলেই ভোর থেকে রাত ১১টা অবধি মাইক বাজায় যারা, তাদের অনুরোধ করলেও বন্ধ করবে না জেনে আমরা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। তেমনই আপাত উদাসীন হয়ে বেঁচে থাকার কায়দাটা আমরা ধীরে ধীরে শিখে ফেলেছি। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আগে যা এক কেজি কিনতাম এখন তার পরিমাণ পাঁচশো গ্রাম নামিয়ে বাড়িতে ফিরে বলছি, এ দিয়েই চালাতে হবে। আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে কোনো দল রাস্তা অবরোধ করলে মনে মনে তাদের বাপবাপান্ত করছি। কয়েক বছর আগে আমাকে বিশেষ প্রয়োজনে নিউইয়র্ক শহরে থাকতে হয়েছিল। হোটেলে নয়, পরিচিত এক বাঙালি দম্পতি সাদরে তাদের বাড়িতে মাসখানেক থাকতে দিয়েছিলেন। সেই দম্পতি সকাল ৮টার মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে কাজে বেরিয়ে যেতেন। আমি আমার সময়। ওরা বাড়িতে ফিরলেন সন্ধ্যের মুখে। ফিরে চা খেয়ে ডিনার বানাতেন এবং রাত ৯টার মধ্যেই তা খেয়ে শুয়ে পড়তেন। লক্ষ্য করতাম ওরা খবরের কাগজ পড়েন না, এমনকি টিভিতেও খবর দেখেন না। টিভি খোলেন শুক্রবার বা শনিবার রাতে। তখন কেবল বাংলা ছবি দেখানো হয়। তার বেশির ভাগই উত্তম-সুচিত্রার ছবি। ক্রমশই বুঝতে পারলাম এরা পৃথিবীর কোনো খবর রাখেন না। ভারতবর্ষে বা কলকাতায় কি হচ্ছে, তা জানার তাগিদ বোধ করেন না। অফিসের টিফিনের সময় সহকর্মীরা কি আলোচনা করেন তা আমার জানার কথা নয়। একদিন আবিষ্কার করলাম, অনেক পাতার খবরের কাগজ প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়ে ওদের বাগানে ফেলে দিয়ে গিয়েছে হকার। সেই কাগজ ব্যাগমুক্ত কখনোই করা হয় না। তুলে ময়লা ফেলার ড্রামে রেখে দেওয়া হয়। নিউইয়র্ক থেকে ওয়াহিও শহরে গিয়ে কিছুদিন থাকার সময় দেখলাম একই ব্যাপার সেখানেও চলছে। শেষ পর্যন্ত গৃহকর্তাকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, ‘একদম সময় পাই না। তাছাড়া এত কাগজ দেয় যে পড়ে শেষ করা যায় না। কেউ ফোন করে কোনো খবর জানালে আমরা নেট থেকে প্রিন্ট আউট বের করে পড়ে ফেলি। এককালে সকালে কাগজ না পড়তে পারলে খারাপ লাগত, এখন অভ্যাসটাই চলে গিয়েছে।’ ফিরে এসে আমি ওই এক মাসের প্রতিটি দিনের কাগজ না পড়ে থাকতে পারিনি। অনেক ঘটনা দুঃখ দিয়েছে, কিন্তু মনে হয়েছে এত অপরাধ এখন রোজ হচ্ছে, কাগজগুলো তা যদি না লেখে তা হলে আয়নায় নিজেদের দেখব কী করে!!

সর্বশেষ খবর