রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সিক্রেট কিলার কারা

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাখাওয়াত কাওসার

সিক্রেট কিলার কারা

‘সিক্রেট কিলার’দের সন্ধানে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ৬০ দিনে রাজধানীসহ কয়েকটি স্থানে খুন হয়েছেন অন্তত ১০ জন। খুনের চেষ্টা করা হয় আরও পাঁচজনকে। হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে মসজিদ, গির্জা ও বিদেশি নাগরিকরা। বাদ যায়নি মহররমের তাজিয়া মিছিলও। খুনের তালিকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। এসব হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে জেএমবিকে। কোনো কোনো ঘটনার খুনিদের চিহ্নিত করা যায়নি। গত দুই মাসে দেশ কাঁপানো সহিংস সিরিজ ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের। তারা বলছেন, এগুলো সিক্রেট কিলারদের কাজ। সব ঘটনার ধরন ও প্রকৃতি প্রায় একই রকম। পথে চলতে চলতেই ভয়ঙ্কর এ অপরাধীরা খুন-খারাবি ঘটিয়েই লাপাত্তা। নজিরবিহীন নিরাপত্তা-বেষ্টনী গড়ে তুলেও এদের রোধ করা যাচ্ছে না। তারা এতটাই প্রশিক্ষিত যে, শরীরের কোন অংশে আঘাত বা গুলি চালালে অপারেশন শতভাগ সফল হবে, তা তারা ভালোভাবেই জানে। এসব কাজ সিক্রেট কিলাররা করছে বলে নিশ্চিত হলেও এরা কারা, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তাদের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী

বাহিনীর সদস্যরা এখন মাঠে। গোয়েন্দা সংস্থার  এক কর্মকর্তা বলেন, যে ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। একই কায়দায় পরপর দুই বিদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন। তাজিয়া মিছিলে এ অঞ্চলে হামলার ঘটনা ৪০০ বছরের ইতিহাসে ঘটেনি। এ ছাড়া মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের ঘটনা এবারই প্রথম; যাতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত ও ইমাম আহত হন। একযোগে প্রকাশক ও ব্লগারদের দুই অফিসে একই সময়ে হামলা চালিয়ে খুন-খারাবির ঘটনা নজিরবিহীন। ওই কর্মকর্তার মতে, খোদ রাজধানীর জনাকীর্ণ স্থানগুলোয় একই স্টাইলে একের পর এক খুন-খারাবি ঘটিয়ে চলেছে সিক্রেট কিলাররা। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই প্রশাসনযন্ত্র নড়েচড়ে ওঠে, শুরু হয় ছোটাছুটি। কিন্তু খুনিদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না তারা। ক্ষিপ্রতায় প্রশিক্ষিত র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী, ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও তাদের সন্ধানে মাঠে নেমে গলদঘর্ম হচ্ছেন। কিন্তু এখনো এ কিলারদের সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হত্যার হুমকিও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইতিমধ্যে খুলনা ও রংপুরের গির্জার ফাদারদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এতে দেশের ভিতর আতঙ্ক সৃষ্টি করে। সে আতঙ্ক আরও তীব্র হয় পশ্চিমা দেশগুলো যখন বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। এ ধরনের ষড়যন্ত্র বাস্তবে রূপদান করতে গেলে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ছাড়া সম্ভব নয়। তাদের অবশ্যই উন্নতমানের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। তারা এমন অপরাধী বলেই প্রকাশ্যে ঘটনা ঘটিয়েই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। আচমকা হামলা করেই সটকে পড়ে সিক্রেট কিলাররা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম এ রশীদ বলেন, কিছু জঙ্গি দল, উগ্র মতাদর্শী সংগঠন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘটানোর চেষ্টা করছে। তবে এর পেছনে নেপথ্য ভূমিকা পালন করছে জামায়াত-শিবির। একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রাজনৈতিক সংকটে পড়ার কারণেই জামায়াত তাদের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। কারণ তাদের আরও কিছু নেতা ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। তিনি বলেন, আইএসের (ইসলামিক স্টেট) আদলে জামায়াত জঙ্গিদের মাধ্যমে দেশে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের অবতারণা ঘটানোর চেষ্টা করছে। আমাদের দেশে শিয়ারা সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে কখনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। অথচ এখন তারা শিয়াদের টার্গেট করছে। তবে আমার বিশ্বাস, তাদের চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না।

আগাম তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি উল্লেখ করে রশীদ বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচিত যতটা সম্ভব ঘটনা ঘটার আগেই তথ্য সংগ্রহে ভূমিকা রাখা। একই সঙ্গে নেপথ্য ক্রীড়নকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। তাহলেই সহিংসতা কমে আসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে এর সবই অর্গানাইজড ক্রাইম। আমরা এগুলোকে সন্ত্রাসবাদের মধ্যে ফেলতে পারি। তবে একটু সময় নিয়ে বিশ্লেষণ করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই যে সবকিছু করা হচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। অপরাধীরা যেভাবে অত্যাধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করছে সে অনুযায়ী আমাদের পুলিশ বাহিনী অনেক পিছিয়ে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অতি দ্রুত পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং সংস্কার নিয়ে ভাবা উচিত কর্তৃপক্ষের। তবে এ মুহূর্তে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আইটি স্পেশালিস্ট ও সাইকোলজিস্ট চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রচলিত যুদ্ধের বাইরে নতুন আঙ্গিকে নতুন ধারার যুদ্ধে অনিচ্ছাকৃতভাবে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের অনেক দেশ। অনেকেই একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে ইঙ্গিত করছেন। নতুন ধারার রণকৌশল মোকাবিলা করার জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা সত্যিই কি রয়েছে? তিনি আরও বলেন, আমাদের পুলিশবাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে ‘ওভার স্ট্রেজট’ হয়ে পড়েছেন। দায়িত্বের বাইরেও জড়ানো হচ্ছে পুলিশকে। নানা ধরনের সংকটের পরও পুলিশকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত অঙ্গনেও জড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে একেকজন হুমকি পাচ্ছেন আর তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হচ্ছে পুলিশ। তবে দ্রুততর সময়ের মধ্যে পুলিশবাহিনীকে নতুন ধারার রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অতীতে আমরা চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদ দমন করেছি। এবারও যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কূটনৈতিকপাড়া গুলশানে তাভেলা সিজার (৫১) নামে ইতালির এক নাগরিক দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। ওই হত্যার দাগ যেতে না যেতেই ৩ অক্টোবর রংপুরে হোশি কোনিও নামে এক জাপানিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দুই দিন পর ৫ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে বাড়িতে ঢুকে গির্জার যাজক লুক সরকারকে জবাই করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার তিন দিনের মধ্যেই রাত সাড়ে ৮টার দিকে মধ্যবাড্ডার জ-১০/১ বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় ঢুকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২১ অক্টোবর রাতে গাবতলীতে পুলিশের চেকপোস্টে খুন হন এএসআই ইব্রাহীম মোল্লা। এর কদিন পর একই কায়দায় আশুলিয়া চেকপোস্টে খুন করা হয় এক পুলিশ সদস্যকে। ৩০ অক্টোবর শাহবাগ ও মোহাম্মদপুরে দুই ব্লগার ও প্রকাশকের ওপর হামলা হয়। নিহত হন একজন। ২৩ অক্টোবর প্রথম প্রহরে পুরান ঢাকার হোসনি দালানে আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির মধ্যে গ্রেনেড হামলায় ১১৫ জন আহত হন। ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাজ্জাদ হোসেন নামে এক কিশোর এবং পাঁচ দিন পর জামাল উদ্দিন নামে ৫৫ বছর বয়সী আরেকজনের মৃত্যু হয়। তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলার পর বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা। ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালালে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জিম হোসেন (৬০) নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন ইমামসহ আরও তিন মুসল্লি। ১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে ইতালির আরেক নাগরিকের ওপর হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরায় সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন তাইওয়ানের দুই নাগরিকও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর