রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

লাখো শিবির কর্মী লাপাত্তা

সাঈদুর রহমান রিমন

বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত লাখো শিবির কর্মী বছরের পর বছর ধরে লাপাত্তা হয়ে আছেন। নিজ এলাকা ছেড়ে তারা অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপনে রয়েছেন। কিন্তু বিশাল সংখ্যার এ কর্মী বাহিনী কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছেন সে ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তবে শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের সাংগঠনিক শাখা, উপ-শাখার নেতৃস্থানীয় কারও চেহারা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দু-চারজন নেতা-কর্মীর অবস্থান শুধু বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও স্থানীয় সাথী-কর্মীদের পর্যন্ত মাঠে দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে সরকার গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন মামলায় শিবিরের এসব নেতা-কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে দফায় দফায় মামলা হয়। তবে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিবির কর্মীদের নামে পাইকারিভাবে সবচেয়ে বেশি মামলা রেকর্ড হয়। ওই সময় দেশের প্রায় প্রতিটি থানায়ই শিবির কর্মীদের আসামি দিয়ে মামলা রুজু করা যেন পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রধানতম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

২০১৩ সালের ৪ মার্চ বগুড়ায় জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার ঘটনায় সদর থানায় ১০টি এবং শিবগঞ্জ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দায়েরকৃত ১২টি মামলায় মোট ১১ হাজার ২২০ জনকে আসামি করা হয়। একইভাবে দিনাজপুরে ৪০ মামলার ৫৬১ জনকে আসামি করা হয়। সেখানে মামলার এজাহারভুক্ত তিন শতাধিক সক্রিয় শিবির কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের না করে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। রংপুরে ৯২টি মামলায় ৩ হাজার ১৭৮ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গঠন করেছে পুলিশ। সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, কোর্টচাঁদপুর, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, গাজীপুরসহ ৩৪টি জেলায় শিবির কর্মীদের আসামি করে মামলা রুজু হয়েছে। এসব জেলার ছয় শতাধিক মামলায় অসংখ্য শিবির নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। অন্য ২০টি জেলায় আরও দুই শতাধিক মামলা রুজু হয়েছে বলে দলীয় সূত্র থেকেই দাবি করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন মামলার শত শত কর্মী এবং ২০১৩ সাল থেকে হাজার হাজার শিবির আসামি নিজ নিজ এলাকা থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে যান। সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা নানারকম অভিযান চালিয়েও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, আগে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত আসামি হিসেবে শিবিরের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা রাজধানীর উদ্দেশে পাড়ি জমাত। তারা রাজধানীতে শিবির কর্মীদের বিভিন্ন ছাত্র মেসগুলোতে অতিথি হিসেবে আশ্রয় নিতে থাকত। একইভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে গড়ে ওঠা শিবিরের মেসগুলোও হয়ে উঠেছিল আসামি শিবিরের আত্মগোপনের প্রধান আস্তানা। কিন্তু ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় পর্যায়ের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা মেসগুলোর প্রতি নজরদারি শুরু করে। এমনকি শিবিরের মেসগুলো লক্ষ্য করে চালানো বিশেষ বিশেষ অভিযানে সহস্রাধিক শিবির ও জঙ্গি সদস্যকে আটক করার ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নগরীর ছাত্র মেসগুলোতে শিবিরের আসামি সদস্য ও জঙ্গি সদস্যদের আত্মগোপনের প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পরে এই বিশাল সংখ্যার ‘আসামি শিবির’ কোথায় লাপাত্তা হয়েছেন- তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ২২ জানুয়ারি মহাখালীর একটি মেস থেকে ১৩০টি ককটেল, দুই লিটার পেট্রল, ১০ কেজি পাথরের গুঁড়া এবং এক কেজি গান পাউডার ও তিন কেজি ধারালো চার কোণ বিশিষ্ট প্যারেকসহ শিবিরের পাঁচ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- শিবিরের বনানী থানার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানসহ জয়নাল আবেদিন, আরিফুজ্জামান আরিফ, আতিয়ার রহমান ও খালিদ সাইফুল্লাহ। গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের বরাত দিয়ে বনানী থানার ওসি জানান, তাদের ধ্বংসাত্মকমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ‘সাথী’ পদধারী এক নেতা। পুলিশ অভিযান চালানোর আগেই ওই সাথী মেস থেকে পালিয়ে যান। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ভাসানটেকের একটি বাড়ি থেকে পুলিশ একটি পেট্রলবোমা, দুটি ককটেল, পেট্রলভর্তি প্লাস্টিক বোতল দুটি, স্পিরিট জাতীয় তরল পদার্থভর্তি ছোট বোতল একটি, জামায়াত-শিবিরের ইসলামী সংগঠনের ৬০টি বইসহ শিবিরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের গোপন তথ্য ফাইল উদ্ধার করে। এ ঘটনায় শিবিরের ১২ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই ১২ জনের মধ্যে সাথী পদধারী নেতা নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাথী থেকে শুরু করে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের শিবির ক্যাডার নেতারা কেউ আর দৃশ্যমান নেই। অনেকটা হঠাৎ করেই উধাও হয়েছেন তারা। কোথায় গেছেন তারা তা নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার একেকরকম ধারণা রয়েছে। দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সংস্থার স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের সাম্প্রতিক সময়ে অচেনা মুখের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্য একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দুর্গম পার্বত্য এলাকার বিবরণ। তাতে বলা হয়েছে, পাহাড়ের একটি অউপজাতীয় ছাত্র সংগঠন এবং একটি সশস্ত্র উপজাতীয় সংগঠনের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সমতল ভূমির বহু অচেনা মুখ আত্মগোপন করে আছে। তারা দুর্গম পাহাড়ের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় নানা কর্মকাণ্ডের অজুহাত নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর