সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তেজগাঁওয়ে তুলকালাম

অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদে মেয়রকে বাধা । সংঘর্ষ-আগুন । অভিযান স্থগিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

তেজগাঁওয়ে তুলকালাম

তেজগাঁওয়ে গতকাল উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে শ্রমিকদের একটি অংশ এতে বাধা দেয়। তারা মেয়রের গাড়ি ভাঙচুর এবং রাস্তায় টায়ারে আগুন দেয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে গতকাল তেজগাঁওয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। উচ্ছেদ চলাকালে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় পুলিশের সঙ্গে একদল শ্রমিকের সংঘর্ষ বাধে। এতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকরা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে রাবার বুলেট ছুড়ে। এ সময় তিন শ্রমিক  গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে এ উচ্ছেদ অভিযানে ইট ছোড়া নিয়ে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। শ্রমিক মৃত্যুর গুজবে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে সাতরাস্তা মোড় পর্যন্ত। মেয়র আনিসুল হক এ সময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পুলিশ ও র‌্যাবের কড়া পাহারায় তিনি বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন অফিসের ভিতরে অবস্থান করেন। উত্তেজিত শ্রমিকরা এ সময় মেয়রের প্রটোকল গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকও এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। সংঘর্ষ শুরু হলে চালক সমিতির কার্যালয়ে কিছু সময় অবস্থান করে পরে তিনি সেখান থেকে চলে যান।

দুপুর ১টা থেকে শুরু হওয়া এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে। পুলিশ ও র‌্যাবের কড়া প্রহরায় মেয়র বেরিয়ে আসেন ইউনিয়ন অফিস থেকে। এ সময় তিনি উন্নতমানের টার্মিনাল নির্মাণের ঘোষণা দেন। তবে অবৈধ স্থাপনা কোনোভাবেই তিনি মেনে নেবেন না বলে ঘোষণা দেন। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর ১টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের লোকজন ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদের অভিযান শুরু করেন। এ সময় সেখানে ছিলেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। ডিসিসির কর্মীরা বুলডোজার দিয়ে ট্রাক টার্মিনালের পাশের সড়কগুলোর অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। সেসময় পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। অভিযান দলটি টার্মিনালের সামনের সড়কে সারিবদ্ধভাবে রাখা ট্রাক সরানোর উদ্যোগ নেয়। কে বা কারা পুলিশ ও অভিযান দলের ওপর ইট ছুড়ে মারে। এ সময় একটি ট্রাকের গ্লাস ভেঙে যায়। তখন শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ইট মারতে থাকে। সেখানে রেলমন্ত্রী ও মেয়র আনিসুল হকও উপস্থিত ছিলেন। বৃষ্টির মতো ইট ছুড়তে থাকায় পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে মেয়র অবস্থান নেন শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসের ভিতর। রেলমন্ত্রী ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। মেয়র তখন ভিতরে অবস্থান নেন। বাইরে পুলিশের সঙ্গে চলতে থাকে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এ সময় আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ হন এক ট্রাকচালক জসিম উদ্দিন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ট্রাক স্ট্যান্ডে গুজব ছড়িয়ে পড়ে জসিম মারা গেছেন। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। শ্রমিকরা এ সময় সাংবাদিকদের ওপরেও হামলা চালায়। ভাঙচুরের শিকার হয় চ্যানেল আইয়ের গাড়ি। ওই গাড়ির চালক আজহার আহত হন। এ ছাড়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের ফটোসাংবাদিক তানভীর আহমেদের মাথায় ইটের আঘাত লাগে। তার ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। ট্রাক স্ট্যান্ডের সামনের সড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতে থাকে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন অফিসের ভিতরে বসে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাইরে চার-পাঁচজন লোক হই হই করলে তাদের কথা মানতে হবে এর কোনো কারণ নেই। শহরের মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে সেই কাজ করছি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেউ উত্তেজিত করলেন আর আমি আমার লোক নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলাম; না এটা হবে না। ঠিক কী ঘটেছে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, সমস্যা কিছুই হয়নি। কেউ একজন ইট ছুড়েছে। যেটা হচ্ছে সেটা অনভিপ্রেত। ইতিমধ্যে র‌্যাব-২-এর সিও লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদসহ অন্য কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হন। ছুটে আসেন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার। বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্য মোতায়েন করা হয়। রায়ট গাড়িও অবস্থান নেয় ট্রাক স্ট্যান্ডে। বিকাল পৌনে ৫টায় পুলিশের উপস্থিতিতে বেরিয়ে আসেন মেয়র আনিসুল হক। সেখানে শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বক্তব্য রাখেন। পরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়েছে। মেয়র মহোদয় বলেছেন, যা কিছুই করা হবে শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে। তিনি বলেছেন, এখানে যে উচ্ছেদ করা হচ্ছে তা শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য। শ্রমিক আহত হওয়ার ব্যাপারে ডিসি বলেন, যিনি আহত হয়েছেন তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। শ্রমিকেরা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। পুলিশও কোনো অ্যাকশনে যায়নি। তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড দখলমুক্ত করতে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক। ওই সময়ের মধ্যে কেউ ট্রাক সরাননি দেখে তিনি ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান সরানোর জন্য মালিকদের সময় দেন। এর আগে ১ নভেম্বর রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতাদের নিয়ে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন মেয়র। তখন তিনি বলেছিলেন, ৭ নভেম্বরের মধ্যে তেজগাঁওয়ে রেলওয়ের জায়গার অবৈধ স্থাপনা না সরালে ৮ নভেম্বর সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে। ৮ তারিখ থেকে তেজগাঁওয়ের কোনোখানে কোনো ট্রাক দিনে-রাতে দাঁড়াবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। রেলের জমিতে গড়ে ওঠা ট্রাক স্ট্যান্ড চলে গেছে অবৈধ দোকানপাট, পুরনো ও বিকল ট্রাকের দখলে। তাই সারি সারি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান রাখা হচ্ছে সড়কের দুই পাশ জুড়ে। ফলে সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেললাইন পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। ট্রাক স্ট্যান্ডের ভিতরে পুরনো অনেক ট্রাক পড়ে আছে। ট্র্যাক স্ট্যান্ডের ভিতরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক মেরামত কারখানা। এসব দোকানের যন্ত্রাংশ, অব্যবহৃত ও বাতিল জিনিসপত্র পুরো স্ট্যান্ডকে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতেই গতকাল শুরু হয় এ অভিযান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর