নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য আজ বিচারের মুখোমুখি সেই দাপুটেরা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা। নিজেরা যোগসাজশের মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের প্লট। দুর্নীতি ও অনিয়মে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। তারা হলেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, সাবেক গণপূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা। এ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দুদকের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহিরভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দায়ের করা মামলার শুনানি কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। সাবেক গণপূর্ত সচিব ড. শওকতের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তিনটি মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এখন চার্জশিট দেওয়ার পালা। পাশাপাশি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদার বিরুদ্ধে প্লট জালিয়াতির অভিযোগ ফের অনুসন্ধান করবে দুদক। জানা গেছে, গত বছরের ২১ আগস্ট সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের বিরুদ্ধে ৭৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। জ্ঞাত আয়বহিরভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে এ মামলা করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে মান্নান খানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় উল্লেখ করা অস্বাভাবিক সম্পদ বিবরণীর সূত্র ধরে ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি মান্নান খান দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই নির্বাচনে পরাজিত মান্নান খান হলফনামায় তার ১১ কোটি ৩ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। অথচ পাঁচ বছর আগে নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি তার সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছিলেন ১০ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে পাঁচ বছরে মান্নান খানের সম্পদ বাড়ে ১০৭ গুণ। সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী হলফনামায় উল্লিখিত অর্থের ১ কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ২২৭ টাকা আয়ের উৎস দেখিয়েছেন মাছ চাষ। দুদকসূত্র জানায়, তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে মান্নান খানের নামে কোথাও কোনো মৎস্য খামারের অস্তিত্ব ছিল না। এ ছাড়া তিনি দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে জমি বিক্রি বাবদ অর্জিত ২ কোটি টাকার তথ্য গোপন করেছেন। ঢাকার দোহারে নিজ গ্রামে যে আলিশান ভবন বানিয়েছেন তা নির্মাণে অর্থের উৎস এবং মোট ব্যয়ের পরিমাণ তিনি উল্লেখ করেননি আয়কর বিবরণীতে। এসব বিষয়ে দুদকের তদন্ত কমিটি তাকে তলব করে। দুদক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সবকিছু অস্বীকার করেন মান্নান খান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। দুদক কর্মকর্তারা মান্নান খানের অবৈধ সম্পদের তথ্য হাতে পেয়ে যান। এসবের ধারাবাহিকতায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। এ ছাড়া মান্নান খানের স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা সুলতানার নামে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পায় দুদক। মান্নান খান বিগত মহাজোট সরকারে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে যে সম্পদ গড়েছেন তার বিশাল একটি অংশ রেখেছেন স্ত্রীর নামে। সৈয়দা হাসিনা সুলতানা পেশায় একজন গৃহিণী। কিন্তু মান্নান খান তার হলফনামায় স্ত্রীকে ‘ব্যবসায়ী’ বলে উল্লেখ করেন। হলফনামায় সৈয়দা হাসিনা সুলতানার নামে মাছ চাষ থেকে আয় দেখানো হয় ৮৫ লাখ টাকা। অথচ নির্বাচনী এলাকায় মান্নান খান কিংবা তার স্ত্রীর কোনো মাছের খামার নেই বলে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে। দুদকসূত্র জানায়, তদন্তে মান্নান খানের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নামেও তার অর্জিত সম্পদ রয়েছে বলে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এদিকে, সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা তিন মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) শিগগিরই দাখিল করবে দুদক। ২২ এপ্রিল সাবেক পূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শত্তকত হোসেন, তার স্ত্রী আয়েশা খানম, মা জাকিয়া আমজাদের নামে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে রাজধানীর মতিঝিল থানায় পৃথক তিনটি মামলা (৮, ৯ ও ১০ নম্বর) দায়ের করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন শিবলী অভিযোগপত্রের নথি অনুমোদনের জন্য গত রবিবার মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত ও অনুসন্ধান) দফতরে দাখিল করেছেন। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই কমিটির অনুমোদন পেলে তা আদালতে পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এদিকে তদন্তসূত্র জানায়, প্রস্তাবিত চার্জশিটে ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের নামে রাজধানীর দুই জায়গায় জ্ঞাত আয়বহির্ভ‚ত দুটি ফ্ল্যাট কেনার তথ্য-প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া শওকতের নথি পর্যালোচনা করে তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, রাজউকের প্লট বরাদ্দের আগের দিন তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে (বরাদ্দ কমিটির) মোবাইল ফোনে নির্দেশ করতেন। এ ছাড়া পূর্ত সচিব হিসেবে তিনি তার পছন্দের লোকদের রাজউকে পছন্দের পোস্টিং দিয়ে নিজের প্রতি অনুগত রাখতেন। ড. শওকত ১৯৯৭ সালে নড়াইলে এডিসি (রাজস্ব) থাকতে রাজধানীর তেজতুরী বাজারে ১৩৪৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন বলে দুদকের জিজ্ঞসাবাদে স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া রাজধানীর পলবীতে (খতিয়ান নম্বর আরএস ৩৭৩, এসএস ১৩১, দাগ নম্বর এসএ ও সিএস ৮১৬) তার ৭ শতাংশ জমি তিনি ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের সঙ্গে বিনিয়ম করেন। পূর্ত সচিব থাকাবস্থায় এ জমির বিনিময়ে তিনি ইস্টার্ন হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে পলবীর অন্য স্থানে (খতিয়ান নম্বর সিএস ৭৩৬, এসএ ৬৫৯-আরএস ১১৪, দাগ নম্বর এসএ ও সিএস ৬৬১) অতি মূল্যবান ৭ শতক জমি গ্রহণ করেন। ২০১২ সালের ৬ জুন এ-সংক্রান্ত সম্পত্তি বিনিময়ের ফাইলে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার। কিন্তু বিনিময় করা ৭ শতক জমি তিনি কীভাবে অর্জন করেন সে বিষয়ে এ নথিতে কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া পরবর্তীকালে তিনি একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে পলবী এলাকার ৭ শতাংশ জমি লিখে দেন। এর বিনিময়ে ওই কোম্পানির কাছ থেকে ইস্কাটন এলাকায় ২৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করেন। ড. খোন্দকার শওকতের ৭ শতক জমির অবস্থান পলবী দ্বিতীয় পর্ব আবাসিক এলাকায়। প্লট নম্বর এন/২৭, রোড নম্বর ৩। আর ফ্ল্যাট পেয়েছেন কাকরাইলে। ড. শওকত পূর্ত সচিব হিসেবে রাজউকের কোনো প্লট কিংবা ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করতে পারেন না। অথচ তিনি প্রকৃত তথ্য গোপন করে রাজউক থেকে প্লট নিয়েছেন। জানা গেছে, নিজ ও স্ত্রীর নামে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হুদাকে কয়েক দিনের মধ্যে ফের তলব করবে দুদক। এ ছাড়া জালিয়াতির অভিযোগে নুরুল হুদাকে দুবার তলব করেছিল দুদক। দুদক অনুসন্ধানসূত্র জানায়, নিজে রাজউক চেয়ারম্যান থাকাকালে যথাযথ নিয়ম উপেক্ষা করে নুরুল হুদা স্ত্রীর নামে আদিবাসী প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লট পাল্টে নিজের পছন্দমতো কর্নার প্লট নেন। দুদক কর্মকর্তারা জানান, প্রকৌশলী নুরুল হুদার স্ত্রী আদিবাসী না হওয়া সত্তে¡ও রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে তাকে আদিবাসী কোটায় একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত ২ নভেম্বর দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা জুলফিকার হায়দার প্রকৌশলী নুরুল হুদার কাছে প্লটপ্রাপ্তির দালিলিক কাগজপত্র দাখিল করতে চিঠি দেন। এ চিঠি পেয়ে নুরুল হুদা স্ত্রীর নামের প্লটটি ফিরিয়ে দিতে রাজউকের কাছে আবেদন করেন বলে জানা গেছে।