বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

ইদানীং মেঘের ঘ্রাণ পাচ্ছি

সমরেশ মজুমদার

ইদানীং মেঘের ঘ্রাণ পাচ্ছি

কয়েক দিন আগে আমার রক্তের রিপোর্ট দেখার পরে ডাক্তার বললেন, ‘খুব বেঁচে গেছেন মশাই’। বেঁচে গেছি মানে? বেঁচে তো দিব্যি আছি! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মানে কী’? ‘আরে আপনার সুগার একদম নরমাল। সুগার বেশি হলে সমস্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। খুব ভালো। আপনি তো সিগারেট ছেড়েছেন বছর দেড়েক আগে, এবার খাসি বা পাঁঠার মাংস খাওয়া বন্ধ করুন। প্রেসারের ওষুধটা নিয়মিত খেতে ভুলবেন না।’ ডাক্তার বললেন।

দেখতে দেখতে ৭০ পেরিয়ে গেলাম কিন্তু আমার জীবনযাপন ৪০ বছর আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। সাত সকালে উঠে চা খেয়ে কাগজ পড়ি। তার মধ্যেই জলখাবার। তারপর স্নান, খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়ি। কলেজস্ট্রিট, কাগজের অফিস হয়ে অনুষ্ঠান থাকলে সেখানে ঢুঁ মেরে ক্লাবে যাই। আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরি রাত ১০টায়। বয়স যে বাড়ছে সেই খবর শরীর দুবার দিয়েছিল। একবার আট দিন হাসপাতালে থেকে ফিরে এসে সিগারেট ছাড়তে হয়েছে। দ্বিতীয়বার পেট ফুটো করে গলব্লাডার থেকে পাথর বের করেছেন ডাক্তার। এই দুবার ছাড়া আমার জীবনযাপন পরিবর্তন করার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু ইদানীং আমি মেঘের ঘ্রাণ পাচ্ছি।

ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও সত্যি। দুপুরে খেতে বসে ডাল, ভাজা, তরকারি খাওয়ার পর মনে হচ্ছে পেট ভরে গেছে, মাছের বাটি সরিয়ে রাখছি। এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে। রবিবার মাংস রান্না হয়। খেতে গেলে মনে হয় ছিবড়ে লাগছে! একদিন ডাল, তরকারি বাদ দিয়ে পাবদা মাছের ঝোলের সঙ্গে ভাত খেলাম। ঠিক তৃপ্তি পেলাম না। ছোটবেলায় শুনেছি বয়স হলে মানুষের মাছ-মাংসের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। আর যারা অনুকূল ঠাকুরের শিষ্যত্ব নেন তারা মাছ-মাংস বর্জন করেন। প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দুদা দীর্ঘকাল ওসব না খেয়ে দিব্যি ভালো আছেন। শুধু তিনি নন, তার পরিবারের সবাই। কিন্তু কেউ মাছ-মাংস ছেড়ে দিয়েছে শুনলেই মনে হবে লোকটার বয়স বেড়ে গেছে। জীবনভর অনেক খেয়েছে, এখন বাসনা মরে গেছে। সেদিন একটি বিদেশি ইংরেজি পত্রিকায় অভিনব তথ্য পেলাম। মানুষ সচরাচর সেসব প্রাণীর মাংস খায়, যারা তৃণভোজী। মাংস খেতে অভ্যস্ত প্রাণীর মাংস মানুষ খেতে পছন্দ করে না। হরিণ থেকে ছাগল অথবা ভেড়া মানুষের প্রিয় খাদ্য। কিন্তু বাঘ-সিংহের মাংস সহজে পেলেও মানুষ খেতে উদ্যোগী হয় না। মুরগি কেঁচো বা পোকামাকড় খায় কিন্তু তাদের মাংসাশী বলা যায় না। মাছ জলে থেকে শ্যাওলা জাতীয় খাবার খায়। কিন্তু বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে, মরা প্রাণীর শরীর জলে ভাসলে ইলিশ জাতীয় প্রাণী উল­সিত হয়। কিন্তু সে সব তো কদাচিৎ পাওয়া যায়। দু-বেলার খাদ্যতালিকায় পড়ে না। পত্রিকাটি লিখেছে, এসব তৃণভোজী প্রাণীর মাংস খেয়ে খেয়ে এক সময় মানুষের অরুচি হতেই পারে। তখন তার উচিত কোনো মাংসাশী প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করা। যুক্তির সমর্থনে লেখা হয়েছে সেই লোকটির কথা যাকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখা যায় এবং যে খিদে পেলেই সাপ থেকে হায়নার মাংস তৃপ্তি করে খেয়ে থাকে। আমার সেই বাসনা হচ্ছে না। খাওয়ার জন্য না বেঁচে, বাঁচার জন্য যতটুকু খাওয়ার ইচ্ছে হয় ততটুকুতেই আমি খুশি। তাতে আমার বয়স বাড়ছে বলে কোনো বোধ তৈরি হয় না। কিছুদিন আগে জলপাইগুড়িতে গিয়ে আচমকা সেই বোধ মনে জš§ নিল। আমাদের বাড়ি ছিল হাকিমপাড়ার তিস্তার বাঁধের গায়ে। টাউন ক্লাবের পাশে। বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে অশোকদাদের বাড়ি দেখতে পেতাম। অশোক বসু। আমি যখন জিলা স্কুলের শেষদিকের ছাত্র তখন জলপাইগুড়ির মানুষ অবাক হয়ে দেখেছিল, অশোকদার গল্প ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ওর একটু দূর সম্পর্কের আÍীয় অর্ণব সেনের গল্প আনন্দবাজারে বেরিয়েছে। খুব গর্ব অনুভব করলাম ওদের প্রতিবেশী হওয়ায়। সম্ভবত সেই সময়ই দেবেশ রায়ের আÍপ্রকাশ হয়। এদিন বাড়িটার দিকে তাকাতেই বুকে ভার জš§াল। অশোকদা পৃথিবীতে নেই। খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষটি মাঝখানে লেখা থেকে সরে গিয়েছিলেন। যখন ফিরে আসতে চাইলেন, তখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। বাড়িটা আছে, পৃথিবীর সবকিছু ঠিক চলছে। এই মুহূর্তে অনেক তরুণ লেখক ভালো গল্প লেখার চেষ্টা করছে, শুধু অশোকদা নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে জিলা স্কুলের দিকে পা বাড়াতেই পুনিদের বাড়ি। ওরও নাম অশোক, অশোক ব্যানার্জি। কলকাতায় থাকে। অনেককাল যোগাযোগ নেই। কিন্তু শুনলাম পুনি নেই। এই পৃথিবী থেকে সে একদম মুছে গিয়েছে। পুনি আমারই সহপাঠী। ওপাশে জায়ন্তদের বাড়ি। তার মা হলেন প্রথম মানুষ যিনি আমাকে পথের পাঁচালি পড়িয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষগুলোকে চিনিয়েছিলেন। তিনি আজ নেই। ভাবলেই মন বিষণ্ন হয়ে যায়। করলা নদীর ওপর এককালে ঝুলন ব্রিজ ছিল। এখন শক্ত সেতু। পার হতেই মেয়েদের স্কুল আর স্বপ্নাদের বাড়ি। সেই স্বপ্না যে কিশোরী বেলায় চা বাগানে দিদির বাড়িতে গিয়েছিল। ওর আগে আমাদের কোনো মেয়েবন্ধু ছিল না। মেয়েবন্ধু শব্দটার মধ্যে এক ফোঁটা মালিন্য জমেনি। এসে জানলাম, স্বপ্না নেই। মন বিষণ্ন হয়ে গেল। পাহাড়ি পাড়ার মুখে জীবনের বইয়ের দোকান। জলপাইগুড়িতে গেলেই ওর দোকানের সামনে আড্ডা। জীবন চা খাইয়ে যেত। জীবন বলত, ‘অনেক দিন পর আসলেন’, আমাদের মনে নেই জীবন এখন নেই। দোকানের সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। জীবন, আপনারও তো মনে থাকল না! মন বিষণ্ন হয়ে গেল। আর সেটা হলো নিজের জন্য। প্রিয় মানুষেরা সবাই এক এক করে চলে যাচ্ছেন। ওদের চলে যাওয়া মানে আমাকেও তৈরি হতে হবে। আমারও তাহলে বয়স বাড়ছে। কিন্তু আমি যে জীবনযাপন করি তা আমার বয়সে বাবা ভাবতেই পারতেন না। তাহলে নিজেকে বদলাব কেন? কেন উদ্যোগী হব সব ছেড়ে দিতে। এই তো ভালোবাসার বয়স।

সর্বশেষ খবর