বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দেখেছি আনন্দাশ্রু স্বজন হারানোর বেদনা

কর্নেল জাফর ইমাম (অব.) বীরবিক্রম

দেখেছি আনন্দাশ্রু স্বজন হারানোর বেদনা

’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মুহূর্তে দেখেছি মানুষের চোখে আনন্দের অশ্রু। দেখেছি স্বজন হারানোর বেদনা। বিজয়লগ্নে বাংলার জনপদগুলোতে চলছিল উল্লাসের মিছিল। আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সেদিন ছিল না দলীয় পরিচয়। স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তি ছিল ঐক্যবদ্ধ। সবার একটাই স্বপ্ন ছিল- নিজের মতো করে নিজেদের দেশটা গড়ব। থাকবে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ। সেই উচ্ছ্বাস আর আবেগ আজ হারিয়ে যাচ্ছে? আজ তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে শহীদদের স্বপ্ন-সাধ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর ঐক্যের পথ রাখতে হবে উম্মুক্ত। সজাগ থাকতে হবে। আমাদের কোনো ভুলের জন্য জাতি যেন দ্বিধাবিভক্ত না হয়ে পড়ে। বিজয়ের মুহূর্তে সবার একটাই আশা ছিল- কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের দেশ গড়ব। যেখানে থাকবে না কোনো হানাহানি বা ক্ষমতার লড়াই। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে যেভাবেই স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু যারা জীবন বাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করা উচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রায় চার হাজার সেনা অফিসার ও সৈনিক আমাদের স্বাধীনতার জন্য তাদের বুকের রক্ত দিয়ে বাংলার মাটি রঞ্জিত করেছিলেন। তাদের সম্মান দিতে আমরা কার্পণ্য করি কেন? শুনেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতীয় শহীদ পরিবারের সদস্যরা বাড়তি সুযোগসুবিধা পান না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় রয়েছে। আমাদের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ভারত থেকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংগ্রহ করে মরণোত্তর সংবর্ধনা দেওয়া, তাদের নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিদেশিদের সম্মাননা দিচ্ছে। দেরিতে হলেও এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে বা রাজনৈতিক দলে থাকাটাই স্বাভাবিক। যেখানেই থাকুক না কেন সবাই দেশপ্রেমিক। দলীয় কারণে তাদের বিতর্কিত করা সমীচীন নয়।

 

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অন্যতম জাতীয় ঐতিহ্য, অহংকার এবং গর্ব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে চেতনা নিয়ে জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সে চেতনা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। জাতি বীরদের সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জাতি বড়ই অভাগা। শুধু বিজয় আর স্বাধীনতা দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সবাই সোচ্চার হয়। মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্ন থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাÍক সহযোগিতা এবং নয় মাসের যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন রণাঙ্গনে তাদের প্রায় চার হাজার সেনা সদস্য হতাহত হয়েছিলেন। আজ আমাদের শহীদদের স্মরণের পাশাপাশি তাদের আÍাহুতিকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। ৪৪ বছর আগে যে স্বপ্ন নিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, সে স্বপ্নের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তফাত আকাশ-পাতাল। কেন এ তফাত, এর কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভাবের কারণে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে। তাই আমাদের জাতীয় বা আইনিভাবে যে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে তা হলো- মুক্তিযুদ্ধকে যারা এখনো স্বীকার করে না গণ্ডগোলের বছর বলে, তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করতে হবে, অন্যথায় দেশের উন্নয়ন ও জাতীয় বিকাশে তারা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে গাজী তারা আজ চরম উপেক্ষিত। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। জাতি যেন আমাদের করুণা না করে। আমরা শহীদদের কাছে চলে যাওয়ার আগে দেখে যেতে চাই বীরদের যেন সম্মান দেওয়া হয়। গণযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি রণাঙ্গনে যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তারাও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে শত্র“পক্ষের শেলিংয়ের আক্রমণে অনেকে ঘরবাড়ি, সম্ভ্রমসহ সবকিছু হারিয়েছেন। সবাই সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সবাই আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অবদান রয়েছে। কিন্তু যারা জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের ইতিহাস যদি লিপিবদ্ধ না করি তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজম্ম কখনো স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারবে না। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে অর্জন নেই তা নয়। যদি সবাই এক হয়ে একাত্তরের মনমানসিকতা ও উদ্দীপনা নিয়ে দেশ গড়তে পারতাম তাহলে অর্জন আরও বেশি হতে পারত। ফেনী পাক হানাদারমুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। ’৭১-এর এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখসমরে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ফেনীর মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। ফেনী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত আমি তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (পরবর্তীতে লে. কর্নেল) ভারতের বিলোনিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অভিযান চালিয়ে বিলোনিয়া, পরশুরাম, মুন্সীরহাট, ফুলগাজী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে এগোতে থাকলে পর্যুদস্ত হয়ে ফেনীর পাক হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তায় এবং অন্য অংশ শুভপুর ব্রিজের ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেক রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীরহাটের মুক্তারবাড়ী ও বন্ধুয়ার প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছে। প্রথম বিলোনিয়া যুদ্ধে মুন্সীরহাটে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে প্রথম শহীদ হন হাবিলদার নূরুল ইসলাম। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রায় ৩০০ সেনা হতাহত হয়েছিল। হাবিলদার নূরুল ইসলাম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। বিধ্বস্ত নূরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না। স্যার, আপনারা চালিয়ে যান। আমাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ কালিমা পড়ে জয় বাংলা বলে আমাদের থেকে বিদায় নেন নূরুল ইসলাম। তখন নূরুল ইসলামের রক্তে আমাদের বাংকার রক্তাক্ত হয়েছিল। তারও ভবিষ্যৎ ছিল। আজকের বাংলাদেশে তারও স্বজনদের নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। আমরা যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছি শহীদদের আর্তনাদ শুনতে পাই। তারা বলেন, তাদের স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ বিজয় লাভ করেছিল। কিন্তু আগেই ফেনীসহ দেশের যে জেলাগুলো মুক্ত হয়েছে। যে তারিখে যে জেলা মুক্ত হয়েছে ওই তারিখে সংশ্লিষ্ট জেলায় সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি। অনুলিখন : শফিকুল ইসলাম সোহাগ

সর্বশেষ খবর