রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাশিয়া ভেটো না দিলে ইতিহাস অন্যরকম হতো

মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অব.)

রাশিয়া ভেটো না দিলে ইতিহাস অন্যরকম হতো

একাত্তরের ডিসেম্বর মাসটি অত্যন্ত ঘটনাবহুল।সপ্তাহের প্রথম দিকেই পাকিস্তান বাহিনী আঁচ করতে পেরেছিল যে, তাদের সময় ঘনিয়ে আসছে। এ জন্যে ডিসেম্বরের ৫ তারিখের দিকেই পাকিস্তানের নৌবাহিনী খুলনা নেভাল বেইস ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে অনুযায়ী বঙ্গোপসাগর হয়ে সিঙ্গাপুরের     দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খুলনা থেকে বঙ্গোপসাগরে যেতে হলে প্রায় ৭০-৮০ মাইল সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। নৌবাহিনী যখন সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে যায় তখনই তারা তিন-চার জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে আমাদের (মুক্তিবাহিনীর) বাধার সম্মুখীন হয়। আর তখন চীনা নৌবাহিনীর সদস্যরাও বঙ্গোপসাগরের দিকে আসে তাদের এগিয়ে নিতে। ফলে যুদ্ধ বাদ দিয়ে আমাদের গোলাগুলির মুখেই পাকি নৌবাহিনী দ্রুত সিঙ্গাপুরের দিকে পালিয়ে যায়। আমি তখনো সুন্দরবনের মুখে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে অবস্থান করি। এর প্রায় মাসখানেক আগে ভারতীয় সৈন্য ও বাংলাদেশি কিছু সেনা সদস্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহিনীর একটি অংশের দায়িত্বে ছিলেন— ব্রিগেডিয়ার সালেহ। তিনি একদিন আমার হাতে একটি (ভারতীয়) ওয়ারলেস সেট দিয়ে বললেন, এটির রেঞ্জ হলো ১ হাজার ৬০০ মাইল। তুমি প্রয়োজন মনে করলে এর মাধ্যমে ভারতীয় তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গেও কথা বলতে পার। ব্রিগেডিয়ার সালেহ্র এ কথা শুনে আমি মনে মনে হাসলাম। কারণ, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জিয়াউদ্দিন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আর কী কথা বলবে! তারপরও আমার কমান্ডারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি ভারতীয় সেই ওয়ারলেস সেট গ্রহণ করে একজন কর্পোরালকে সেটটি দিয়ে দায়িত্ব প্রদান করি এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধ সংক্রান্ত যত নির্দেশনা আসে সেগুলো পালন করতে থাকি। ৬ ডিসেম্বর ওয়ারলেস সেটটি হঠাত্ বেজে ওঠে। ভারতীয় পক্ষ থেকে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান সপ্তম নৌবহর আসছে। তুমি কোথায়? আমি বললাম আমি সুন্দরবনের মুখে আছি। তখন আমাকে বলা হলো— তুমি বিষয়টি ওয়াচ কর এবং আমাকে রিপোর্ট কর। আমি বললাম, ইয়েস। তারপর আমি সেভাবেই কাজ করি। আসলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আগে থেকেই এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। তারা সে অনুযায়ীই আমাকে নির্দেশনা দেয় এবং আমিও কাজ করি। দুই দিন যেতে না যেতেই হঠাত্ করে ওয়ারলেস সেটে আবারও বলা হয়, দুবলার চর থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ‘এন্টারপ্রাইজ’ নামক একটি নেভাল ক্রাফট অবস্থান করছে। সতর্ক থেকে ভালো করে এর অবস্থান ওয়াচ কর এবং আমাকে রিপোর্ট কর। আমি তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সেই কর্মকর্তাকে বললাম, ‘কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। সুন্দরবনের ঠিক মুখেই আমি এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছি। কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার।’ আমার এই বক্তব্য শুনে তো ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার আক্কেল গুড়ুম। হেসেই একেবারে গড়াগড়ি তার। শুধু তাই নয়— ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে সেসময় উপস্থিত সবাইকেই তিনি আমার বক্তব্যের রেকর্ড শোনান। আর তখন উপস্থিত সবাই নাকি খুব হাসাহাসি করেন— এই বলে যে, একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হয়ে আমি মাত্র এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বলছি যে, কোনো চিন্তা করবেন না স্যার, কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না। তার মানে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে আমি মার্কিন সপ্তম নৌবহরের মোকাবিলা করব। আমার এই বক্তব্য নিয়ে তারা একদিকে যেমন হাসাহাসি করেন, অন্যদিকে তেমনি তারা আমার প্রশংসাও করেন এই বলে যে, কতটুকু মনোবল, সাহস আর দেশের প্রতি আন্তরিকতা থাকলে একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মাত্র এক কোম্পানি সৈন্য সঙ্গে নিয়ে বলতে পারে যে, ‘মার্কিন সপ্তম নৌবহর কেন কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না’। এরপর ওয়ারলেসে আরেকটি বার্তায় আমাকে জানানো হয়, রাশিয়ান নৌবহরের ২১তম বহরটি বঙ্গোপসাগরের দিকে আসছে। ভালো করে তার অবস্থান ওয়াচ কর। আমি বললাম— ইয়েস। আর তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে, মার্কিন নৌবহর আমাদের শত্রুপক্ষ হলেও রাশিয়ান নৌবহর আমাদের পক্ষে আছে। এরপর দেখলাম আমেরিকা ও রাশিয়ার দুটি নৌবহর কিছুটা দূরত্বে বঙ্গোপসাগরে দাঁড়িয়ে আছে। আর তখন চীন ও আমেরিকা অপেক্ষা করে দেখছিল (যুদ্ধবিরতি ও সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করার) জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে রাশিয়া ভেটো তথা বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ভোট দেয় কিনা? কিন্তু রাশিয়া (তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) দিল ভেটো। সেদিন যদি রাশিয়া ভেটো না দিত, তবে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। ভেস্তে যেত এত তাড়াতাড়ি যুদ্ধ জয়লাভ। প্রলম্বিত হতো কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষ, সব কিছু ধ্বংস করে দৈত্যের হাসি হাসত পাকিস্তান। কিন্তু মিসেস (ইন্দিরা) গান্ধী সেদিন রাশিয়া থেকে আমাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। রাশিয়া তখন পাকিস্তানের বিপক্ষে ভোট দিল এবং যুদ্ধ চলল। আর পাকবাহিনীর সদস্যরা পাততাড়ি গুটাতে লাগল। প্রথম দিকে প্রায় এক লাখ সৈন্য নিয়ে পাকবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেও ডিসেম্বরের ১০-১১ তারিখের দিকে দেখা গেল— ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্য আছে মাত্র ৫ হাজারের মতো। সেজন্য খুব কম সময়ে এবং সহজেই বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে আমাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বাইরেও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১৮ হাজারের মতো সৈন্য হতাহত হয়েছিল। এরপর আমরা বরিশাল ও খুলনা হয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিলাম। পথে পথে দেখলাম প্রতিটি রাস্তায় সাধারণ মানুষ নেমে এসেছে। তারা মূল্যবান কী যেন পেয়েছেন। কিন্তু মুখে ভাষায় কেউ তা প্রকাশ করতে পারছেন না। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখামাত্রই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করছেন। কেউবা আমাদের গালে চুমু খাচ্ছেন। আবার কেউ মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। এই ছিল বাংলাদেশের অর্জন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইতিহাস ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো— স্বাধীন বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র। আর সেটিই হলো— আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। কিন্তু তারপরও আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) মনের গহিনে সেদিন একটি আশঙ্কা সুপ্ত অবস্থায় ছিল। প্রকৃত অর্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বুঝি শেষ হয়নি। পরাজিত শক্তি আবারও হয়তো একদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আবারও বিপন্ন হতে পারে বিশাল আত্মত্যাগের এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শ, গণতন্ত্র। এমনকি আবারও হুমকির মুখে পড়তে পারে— আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও। অনুলিখন : শফিউল আলম দোলন

সর্বশেষ খবর