মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সফটওয়্যার বন্ধ করে শেয়ার কারসাজি

সার্ভার সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেই

আলী রিয়াজ

আধুনিক প্রযুক্তির সফটওয়্যার জালিয়াতির মাধ্যমে কারসাজি চলছে শেয়ারবাজারে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কয়েক দিন পরপর কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় ট্রেডিং সফটওয়্যার। এমনকি সারা দিন লেনদেন শেষে শেয়ার সেটেলমেন্ট (নিষ্পত্তি) করা যায় না। শক্তিশালী একটি চক্র এক বছর ধরেই চালাচ্ছে এ কারসাজি। সফটওয়্যারে বার বার ত্রুটি নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না। ঘটনার পর ডিএসইর পক্ষ থেকে এমন ঘটনা ঘটবে না বলে দুঃখপ্রকাশ করা হয়। কিন্তু তাদের দুঃখপ্রকাশ শুধু কাগজে কলমে। কোনো দুঃখপ্রকাশে বন্ধ হয়নি ট্রেডিং সার্ভার ত্রুটি। পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন ঘটনা ঘটে না, বাংলাদেশে বার বার ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন চক্র জড়িত রয়েছে এ সার্ভার ত্রুটির সঙ্গে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পাঁচবার কারিগরি ত্রুটির শিকার হয়ে লেনদেন বন্ধ রাখতে হয়। বিভিন্ন ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স, বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে ডিএসই কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও প্রতিষ্ঠানটি এ সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারছে না। ত্রুটি সংশোধনের পর কয়েক দিন যেতে না যেতেই ফের একই ঘটনা ঘটছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবার সার্ভার ত্রুটি ঘটলেই নির্দিষ্ট কিছু শেয়ার লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় সব স্বাভাবিকভাবে চললেও দিন শেষে নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন সেটেলমেন্ট (নিষ্পত্তি) করা যায় না। পরদিন ঠিকভাবে চললেও এক দিনে এসব কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সাম্প্রতিক সময় এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিয়ে সুস্পষ্ট জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জরিমানা করেছে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের। ডিএসইর কয়েকজন সাবেক পরিচলক এসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে জড়িত। জানা গেছে, সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর সার্ভার সমস্যায় সব কোম্পানি একসঙ্গে লেনদেন শুরু করতে পারেনি। ট্রেডিং শুরুর আগে কোম্পানির শেয়ার লিমিট ও ক্যাশ লিমিট ডিএসইর সার্ভারে ইনপুট দিতে হয়। এরপরই সাড়ে ১০টায় একসঙ্গে লেনদেন শুরু হয়। কিন্তু সার্ভার সমস্যার কারণে সব কোম্পানির তথ্য সার্ভারে না দিতে পারলেও কিছু কোম্পানিকে বাদ দিয়েই ডিএসইর লেনদেন শুরু হয়। যেসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন বন্ধ রেখে লেনদেন চলে বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের শেয়ারগুলোতে বিভিন্ন কারসাজি করা হচ্ছে। নভেম্বর মাসেই দুবার সফটওয়্যার ত্রুটিতে লেনদেন বন্ধ রাখা হয়। সারা দিন বন্ধ না রাখলেও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার বন্ধ রেখে চলে লেনদেন। এর আগে ১২ আগস্ট একই কারণে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট লেনদেন বন্ধ ছিল। মে মাসে টানা দুই দিন কারিগরি ত্রুটির কারণে লেনদেনে বিঘ্ন ঘটে। ২৪ মে ৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট ও ২৫ মে পৌনে ২ ঘণ্টা লেনদেন বন্ধ থাকে। নতুন সফটওয়্যার চালু করার আগে গত বছরের ১৩ এপ্রিল লেনদেন শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যে ডিএসইর সার্ভার থেকে ব্রোকারেজ হাউসের সার্ভার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে লেনদেন বন্ধ হয়। ২০১২ সালের ৫ ও ৯ ডিসেম্বর এবং ২০১৩ সালের ২০ মার্চ নতুন কোম্পানির লেনদেনে ত্রুটি ঘটায় লেনদেন কয়েক ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। ওই সময় সফটওয়্যার জালিয়াতির ঘটনায় ডিএসইর এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ট্রেডিং সফটওয়্যার সমস্যার কারণে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এ সফটওয়্যার চালু করা হয়। স্বাভাবিক অটোমেশনে কন্ট্রোল প্যানেলে একজন আইটি বিশেষজ্ঞ রাখতে হয়। বর্তমানে ডিএসইতে কোনো চিফ টেকনিক্যাল অফিসার (সিটিও) নেই। এ সফটওয়্যার সরবরাহ প্রতিষ্ঠান নাসডাকের সঙ্গে চুক্তির পর ডিএসইর চিফ টেকনিক্যাল অফিসার পদত্যাগ করেন। আর কোনো সিটিও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অটোমেশনের নামে সফটওয়্যার আধুনিকায়ন করতে ১০ বছরব্যাপী এ প্রকল্প চলবে। ডিএসইর সাবেক একজন প্রেসিডেন্টের সম্পৃক্ততায় অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কেনা হয়েছে এ সফটওয়্যার। সফটওয়্যার কেনার সময় বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সে অভিযোগ আমলে না নিয়েই এ সফটওয়্যার চালু করা হয়। এ ক্ষেত্রে ট্রেডিংয়ের প্রতিটি সদস্য হাউস থেকে টাকা নেওয়া হয়। বার বার একই ধরনের সমস্যা কেন হচ্ছে— এ নিয়ে ডিএসইর কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলছেন না। ডিএসইর এমডি স্বপনকুমার বালা প্রতিবার ত্রুটির পর ‘এমন আর হবে না’— মন্তব্য করেই নিজের দায় সারছেন। এর পরও এমন ঘটনা কেন ঘটছে— সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদও আইটি বিভাগ নিয়ে খুবই বিরক্ত। একজন স্বাধীন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ত্রুটিমোচনে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বর্তমান এমডিকে বার বার বলেও ফলোদয় হয়নি। বার বার লেনদেনে বিঘ্ন ঘটছে। শুধু তাই নয়, এক সপ্তাহে দুবার একই ঘটনা ঘটে, যা বাজারের জন্য খুবই হতাশার। এসব কারণেই বাজারের স্বাভাবিকতায় বাধা ঘটে। জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এত টাকা খরচ করে যে সফটওয়্যার কেনা হলো, তা বিনিয়োগবান্ধব নয়। কারণ আমার নিজের চোখে দেখছি, ৮০০ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হলে আর অর্ডার নিতে চায় না। ফলে বিষয়টি বিএসইসিকে তদন্ত করে দেখতে হবে। এর সঙ্গে কোনো চক্র জড়িত থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে এ ধরনের সমস্যা বার বার হবে।

সর্বশেষ খবর