শিরোনাম
রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তিন বছর পরই খুলছে পদ্মা সেতু

দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্নযাত্রার উদ্বোধন । যাবে রেল, গ্যাস লাইন । ব্যয় ২৯ হাজার কোটি টাকা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

তিন বছর পরই খুলছে পদ্মা সেতু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল পদ্মা সেতুর মূল অংশের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

অবশেষে গতকাল পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর। ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় এখন গোটা দেশ ও জাতি। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর স্বপ্নযাত্রা। আর এ স্বপ্নের শুভ সমাপ্তিও আর বেশি দূরে নয়। তিন বছর পরই খুলে যাবে দেশের সর্ববৃহত্ এ সেতু। সেই সঙ্গে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা তথা গোটা অর্থনীতিতে ঘটবে এক অবিশ্বাস্য বিপ্লব। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সেতু কেবল বৈশ্বিক যোগাযোগকেই সমৃদ্ধ করবে না, রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষকে আবদ্ধ করবে নিবিড় সেতুবন্ধে। রাজধানী মধ্যমণিতে রেখে সহজ হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ।

পদ্মা সেতু-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালের মধ্যেই শেষ হবে এ সেতুর নির্মাণকাজ। আগামী তিন বছরের  মধ্যেই মানুষের জন্য খুলে যাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ইতিমধ্যে শেষ হওয়া কর্মকাণ্ড ও চলমান মহাকর্মযজ্ঞও এটিই প্রমাণ করে যে, নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে সেতু নির্মাণের কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের এক পর্যায়ে সবাই ধরেই নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এ সেতু করা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু আজ সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর একাগ্রতা এবং দৃঢ় সংকল্পের কারণেই সত্যি হতে চলেছে সেই সেতু তৈরির স্বপ্ন। অর্থাত্, কোনো ষড়যন্ত্রই আটকাতে পারেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

কেমন হবে পদ্মা সেতু : আয়তন ও নির্মাণ ব্যয়— দুই দিক থেকেই পদ্মা সেতু হবে দেশের বৃহত্তম সেতু। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এর অবস্থান হবে দ্বিতীয়। প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত এ সেতুর দৈর্ঘ হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এর এক প্রান্ত হবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাট, অন্য প্রান্ত শেষ হবে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে। সেতুর মাওয়া প্রান্তে ১ হাজার ৪৭৮ মিটার ভায়াডাক্ট (ঝুলন্ত পথ) থাকবে। জাজিরা প্রান্তে ঝুলন্ত পথ থাকবে ১ হাজার ৬৭০ মিটার। এ ঝুলন্ত পথগুলো সেতুকে অ্যাপ্রোচ রোডের (সংযোগ সড়ক) সঙ্গে যুক্ত করবে। মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালসড়ক। পুরো সেতুটি দাঁড়িয়ে থাকবে ৪২টি পিলারের ওপর। এর মধ্যে ৪০টিই থাকবে নদীর ওপর। আর বাকি দুটি দুই প্রান্তে, সংযোগ সেতুতে। নদীর ভিতরের ৪০টি পিলারের প্রতিটিতে ৬টি করে মোট ২৬৪টি পাইল করা হবে। এক পিলার থেকে অন্য পিলারের দূরত্ব হবে ১৫০ মিটার। উচ্চতা হবে ১৩ দশমিক ৬ মিটার বা প্রায় ৪৪ ফুট। দ্বিতল এ সেতুর ওপর দিয়ে (আপার ডেক) চলবে যানবহন আর নিচ (লোয়ার ডেক) দিয়ে যাবে ট্রেন। রেলের গতি হবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। ফুটপাথ ও সেতুর রেলিংয়ের জন্য দুই পাশে আড়াই মিটার করে জায়গা থাকবে। সেতুর ওপরে চার লেনের রাস্তার প্রস্থ হবে প্রায় ৫৬ ফুট। দুই ডেককে আলাদা করা হবে আড়াআড়িভাবে বসানো ট্রেসের মাধ্যমে। ট্রেন ও যানবাহন চলাচল ছাড়াও সেতুতে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ থাকবে দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য। ৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসবে অপটিক্যাল ফাইবার ও টেলিযোগাযোগের লাইন স্থাপনে। উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনেরও ব্যবস্থা থাকবে। এ সেতু দিয়েই দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছাবে গ্যাস। দূর হবে বিদ্যুতের ঘাটতিও। সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু ঘিরে হংকংয়ের আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে।

নির্মাণ ব্যয় : কয়েক দফা সংশোধনের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পের সর্বশেষ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

নির্মাণের দায়িত্বে যারা : নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের পর ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর জাজিরা সংযোগ সড়কের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় এএলএম এইচসিএম (জেভি)-কে। গত বছরের ১৭ জুন মূল সেতুর ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন- এমবিইসিকে। নদীশাসনের জন্য চীনের সিনো হাইড্রোর সঙ্গে চুক্তি হয় গত বছরের ১০ নভেম্বর। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে চীনা দুই প্রতিষ্ঠান মালামাল এনে কাজ শুরু করে। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করছেন প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের খ্যাতনামা ২০-৩০ জন প্রকৌশলী। আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে রাত-দিন খাটছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক।

কাজের অগ্রগতি : সেতুর পুরো কাজ প্রধান পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন— জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, নদীশাসন, মূল সেতু, দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মূল সেতুর কাজ। সব কিছু মিলিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ২৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নদী ভাঙন ঠেকাতে নদীর দুই তীরে ১৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। কয়েক দফা নদী ভাঙনের কারণে প্রতিষ্ঠানটি নদীশাসনের কাজ শেষ করতে পেরেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। আর সংযোগ সড়কের মধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরায় ৫৯ এবং মাওয়ায় ৬৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় পদ্মা সেতুর জন্য যাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। আর এ লক্ষ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা ও মাদারীপুর সদর উপজেলায় মোট সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে মোট ১ হাজার ৩৪২টি পরিবারকে প্লট দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৮০ শতাংশ লোককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাকি লোকদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের জন্য মোট ১৪০৮.৫৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে।

আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন : তিন বছর পর সেতুটি চালু হলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ হারে। দীর্ঘতম এ সেতুটি উন্মুক্ত হলে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। বলা হচ্ছে, সেতুটির মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন ঘটবে, তা হিসাবের বাইরে।

স্বপ্নের শুরু যেভাবে : দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদ্মা সেতু। ১৯৯৮-৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের সম্ভাবতা যাচাই করে। এরপর ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ার পদ্মাপাড়ের মত্স্য আড়তের কাছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মাঝখানে চারদলীয় জোট সরকার ও সেনাশাসিত ফখরুদ্দীনের সরকার এ কাজ বন্ধ রাখে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর নকশার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। তবে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু তৈরির চ্যালেঞ্জ নেন। পরে ২০১৪ সালের জুনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২৬ নবেম্বর কার্যাদেশ প্রদান করা হয়।

আছে গণমানুষের অবদান : স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরিতে অবদান রয়েছে অনেক সাধারণ মানুষের। কেউ শ্রম দিয়ে, কেউ উত্সাহ দিয়ে, কেউ বা বাপ-দাদার ভিটেমাটি দিয়ে এ কাজে অবদান রেখেছেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জমি দিতে এলাকার খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও বাদ যাননি। আর সে কারণেই আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি ভূমিহীনদের সরকার প্লট তৈরি করে দিয়েছে। শুধু জমিদাতাদের জন্যই নয়, যারা ভাড়াটিয়া তাদের জন্যও সরকার বিনামূল্যে প্লট করে দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর