মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জঙ্গি বর্বরতায় স্তম্ভিত জাতি সরকার ছিল চরমতম ব্যর্থ

জঙ্গি বর্বরতায় স্তম্ভিত জাতি সরকার ছিল চরমতম ব্যর্থ

বাংলাদেশের (১৯৯১-২০০৬) রাজনীতির ওপর ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ নামে একটি বই লিখেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ‘বাংলাদেশ : এ স্ট্যাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা তার এ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ২০১২ সালে। সরকার ও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একজন সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বইটি লেখেন তিনি। বইটি প্রকাশ করেছে ইউপিএল। বইয়ের চুম্বকাংশের ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাহমুদ আজহার। আজ ৩য় পর্ব।

বিএনপি জোট সরকারের সময় জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়ে বইয়ের ২৮১ পৃষ্ঠার ‘সরকারি প্রতিক্রিয়া ও স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতা’ শিরোনামে এক অনুচ্ছেদে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, “বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে এর প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারতীয় পক্ষ ও আওয়ামী লীগ যতই ইস্যুটিকে তুলে ধরছিল, সরকারও ততই বিষয়টিকে অপপ্রচার আখ্যা দিয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে অনীহা প্রকাশ করছিল। বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের এসব রিপোর্টকে বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করাকে ভারতীয় প্রচারণায় বলে মনে করা হচ্ছিল। পক্ষান্তরে সরকারের কতিপয় দায়িত্বশীল নেতা এই বলে অভিযোগগুলো অস্বীকার করে যে, ‘বাংলা ভাই’ আসলে মিডিয়ার সৃষ্টি এবং বাংলাদেশে ‘বাংলা ভাই’     বলে কারও অস্তিত্ব নেই। সরকারের এই ভ্রান্ত বিচারবোধে নির্লিপ্ততা আরও বেড়ে যায় এবং দেশের সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠে।” বইতে তিনি উল্লেখ করেন, “২০০৩ সালে সদর দফতর রাজশাহীতে স্থানান্তরিত করার পর জেএমবি প্রকাশ্যে তত্পরতা শুরু করে। জেএমবির দ্বিতীয় প্রধান সিদ্দিকুর রহমান ওরফে ‘বাংলা ভাই’ এর নেতৃত্বে জেএমবির অঙ্গসংগঠন জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) এ সময় উত্তরাঞ্চলীয় জেলা নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নড়াইল, বগুড়া ও রাজশাহীতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছিল। এসব এলাকায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সর্বহারা গ্রুপগুলোর বিভিন্ন নামে ও ব্যানারে কাজ করছিল। এসব দলগুলো ছিল মূলত ডাকাত গোছের এবং নিজেদের স্থানীয় নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে এলাকায় প্রাধান্য বিস্তারের জন্য তারা নিজেদের মধ্যেই এক রকম লড়াই শুরু করে দিয়েছিল। খুন, লুট, ধর্ষণ ও লোকদের জিম্মি করে অর্থ আদায়ই ছিল তাদের পেশা।” দলের স্থায়ী কমিটির এই সিনিয়র সদস্য তার বইয়ে বলেন, ‘স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসন ছিল প্রতিরোধে অক্ষম এবং ডাকাত দল গোপন আস্তানা থেকেই কর্মকাণ্ড চালাত। সর্বহারা ও স্থানীয় বিএনপি ক্যাডারদের মধ্যেও বিরাজ করছিল দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাসীন দলের একজন উপমন্ত্রীর ভাতিজা গামা একটি সর্বহারা দলের হাতে নিহত হলে এই দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। এই পর্যায়ে মন্ত্রী জেএমজেবিকে ব্যবহার করে সর্বহারাদের দমনের উদ্যোগ নেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে এক অসুরকে তাড়াবার জন্য তিনি অন্য এক বিপজ্জনক অসুরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সর্বহারাদের হাত থেকে নিস্তার প্রত্যাশী সাধারণ লোকজনের দাবিতে এলাকার মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যও এ সময় জেএমবিকে সর্বহারাদের প্রতিহত করার অনুমতি দেন। ফলে স্থানীয় প্রশাসন থেকেও সর্বহারাদের উত্খাত করার জন্য জেএমবিকে সমর্থন দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে মার্চ-এপ্রিলে বাংলা ভাই সর্বহারাদের একজনকে খুন করে তার দেহ গাছে ঝুলিয়ে রাখলে দেশব্যাপী তার পরিচিতি ব্যাপক হয়ে উঠে।’ বইটির ২৮২ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালের ১৩ মে প্রধানমন্ত্রী বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের আদেশ দিলে বাংলা ভাই স্থানীয় নেতা ও পুলিশের সহযোগিতায় আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় এবং গোপন আস্তানা থেকে তার জিহাদি অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর আদেশের পরেও বাংলা ভাই গ্রেফতার না হওয়ায় তা ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের নিষ্পৃহতাকেই প্রকট করে তুলে। যাতে কেবল জনগণই নন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও কিছুটা বিস্মিত হন।’ বইটির ২৮৩ পৃষ্ঠার শেষ প্যারায় ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ‘২০০৪ সালের মধ্যভাগ নাগাদ জঙ্গিরা তাদের শাখা প্রশাখা আরও বিস্তৃত করে ও দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক আরও সম্প্রসারিত হয়। নেতাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের সংগঠনও দেশব্যাপী বিভিন্ন ব্যানারে সংগঠিত হয়। সরকারের উপলব্ধির অভাব, নমনীয়তা কিংবা নিষ্ক্রিয়তা যাই হোক না কেন, জঙ্গিরা এই সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করে। কয়েকজন মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের পরোক্ষ সমর্থনে জঙ্গি নেতারা এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যায়। এভাবে বৃহত্তম জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয় জেএমবি। এবার প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ ও রসদ জোগাড়ে আরও পর্যাপ্ত সময় পেয়ে যায়।’ ২৮৭ পৃষ্ঠার প্রথম প্যারার শেষাংশে উল্লেখ আছে, ‘জঙ্গিদের এহেন বর্বর হামলায় গোটা জাতি স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী যে জঙ্গিদের সাংগঠনিক শক্তির তুলনায় কতটা অদক্ষ ও অসংগঠিত, এই ঘটনা থেকে তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। সরকারের পক্ষে এ ছিল চরমতম ব্যর্থতা এবং বিরোধী দলগুলো এ সময় যথার্থভাবেই সরকারের পদত্যাগ দাবি করছিল।’ জামায়াত সম্পর্কে ২৯৭ পৃষ্ঠায় ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ‘সুসংগঠিত দল হলো পাকিস্তানের মাওলানা মওদুদীর ভাবানুসারে পরিচালিত দল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে পক্ষপাতী হলেও তাদের সম্পর্কে প্রকাশ্য ধারণা অনেকটা ভিন্নতর। জেএমবি বা হরকাতুল জিহাদের মতো জঙ্গি সংগঠনের ন্যায় জামায়াতের লক্ষ্য একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাই আদর্শভিত্তিকভাবে এক হওয়ায় শুধু কর্ম প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে তাদের পৃথক করে দেখার কোনো উপায় নেই। প্রক্রিয়া ভিন্নতর হলেও একই উদ্দেশ্য সাধনে ইসলামানুগত্য নব্য যোগদানকারীদের মনে ধারণা জন্মায় যে, জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামী দল তাদের লক্ষ্য সাধনে প্রয়োজনবোধে একে অন্যকে সমর্থন ও আশ্রয় দেবে। এ আশ্রয় ও মনস্তাত্ত্বিক সমর্থনের কারণে জঙ্গিরা সারা দেশে অসংখ্য সংগঠনের মাধ্যমে উত্থিত ও বিকশিত হয়েছে। এ সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সবসময় জঙ্গিবাদের একটি উত্কৃষ্ট চারণক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।’ ‘ইসলামপন্থি দল হিসেবে বিএনপি’ অনুচ্ছেদে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ‘বিএনপি নিজেকে একটি ইসলামপন্থি দল হিসেবে মনে করে। তাই কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠন মনে করে যে, বিএনপি অন্ততপক্ষে তাদের কোনো ক্ষতি করবে না এবং তারা মুক্তভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। বিএনপি জামায়াতকে সরকারের অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়ার পর মনস্তাত্ত্বিকভাবে এ বিশ্বাস আরও জোরদার হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর