শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

টার্গেট হামলায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান

মির্জা মেহেদী তমাল

টার্গেট হামলায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান

হামলার টার্গেটে এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পীর-পুরোহিত-যাজকদের টার্গেট করে হামলা করা হচ্ছে। গত দেড় মাসে দেশে অন্তত ১১ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে মসজিদ, শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে আর ইসকন মন্দিরে। সর্বশেষ গতকাল জুমার নামাজের সময় চট্টগ্রামে নৌবাহিনী ঘাঁটি ঈশা খাঁ মসজিদে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয় বলে জানিয়েছে আইএসপিআর। এতে কয়েকজন মুসল্লি আহত হন। এ সময় অবিস্ফোরিত বেশ কয়েকটি ককটেলসহ একজনকে আটক করা হয়। এ পর্যন্ত যেসব হামলা হয় তাতে অন্তত তিনজন নিহত এবং আহত হয়েছেন দেড়শতাধিক ব্যক্তি। এসব হামলার কয়েকটির সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ ঘটনার কোনো কিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনি এক পরিস্থিতিতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারও ভীষণ উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের তদন্তে এসব হামলায় জেএমবির জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। দিনাজপুরে মন্দিরে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার জেএমবি সদস্য শরিফুল ইসলাম ইতালীয় পাদ্রি হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোলে ইসকন মন্দিরে গুলি ও বোমা ছুড়ে পালানোর সময় স্থানীয় জনতা তাকে ধাওয়া দিয়ে আটক করার পর পুলিশে দেয়। পুলিশের জেরার মুখে তিনি জানান, ১৮ নভেম্বর সকালে দিনাজপুর শহরের ইতালীয় পিয়ারোকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একের পর এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটলেও সরকারের দাবি : কোনো সমস্যা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো। কোনো সমস্যা নেই। ধর্মীয় যেসব স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেসব অপরাধী চিহ্নিত করা গেছে। কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ জানিয়েছে, এসব হামলা রোধে এবং হামলাকারীদের শনাক্ত করতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মসজিদ কমিটিগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো সিসিটিভির আওতায় আনা হচ্ছে। পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, অত্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনায় হামলা হওয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন পরিকল্পনাকারীরা। এসব হামলা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর সন্ত্রাসের নতুন রূপ। এর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টরাও এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেননি।

দেড় মাসে ১১ হামলা : গত দেড় মাসে দেশের ১১ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। শান্তিপ্রিয় এলাকা হিসেবে পরিচিত দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় এ ঘটনা ঘটেছে। মসজিদ, মন্দির, চার্চ ও বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় হামলাকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীর ব্যাপটিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’-এর পাদ্রি লুক সরকারকে শহরের নিজের ভাড়া বাসায় গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৮ নভেম্বর দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে ফাদার পিয়ারো পারোলারি নামে এক ইতালীয়কে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পিয়ারো পারোলারি পেশায় চিকিত্সক এবং শহরের সুইহারী ক্যাথলিক মিশন চার্চে ৩০ বছর ধরে কর্মরত ফাদার। ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামে শিয়া মুসলিমদের আল মোস্তফা মসজিদে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত এবং তিনজন আহত হন। এশার নামাজ আদায়ের সময় সিজদারত অবস্থায় তাদের ওপর গুলি করা হয়। ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় রংপুরের ব্যাপটিস্ট চার্চ সংঘের ফাদার রেভারেন্ড বার্নাবাস হেমব্রেসহ ১০ জন পাদ্রিকে চিঠি লিখে হত্যার হুমকি দেয় দুর্বৃত্তরা। ২৩ অক্টোবর বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয় রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল। এতে মারা যান দুজন, আহত হন প্রায় দেড়শ’ ব্যক্তি। রংপুরে কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চেতার মোড়ে ১০ নভেম্বর মধ্যরাতে মাজারের খাদেম রহমত আলীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মাসুদ রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাসুদ রানাসহ দুজনকে আটক করা হয়েছে। এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামি থানার বাংলাবাজারে মাজারে ঢুকে দুজনকে নৃশংসভাবে জবাই করে খুন করা হয়। এ ছাড়াও ঢাকার বাড্ডা এলাকায় পীর খিজির খান, রাজাবাজারে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগে কথিত পীর লুত্ফুর রহমানসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনা ঘটে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ক্যামেরা : রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মসজিদ-মন্দির-মাজার ও বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিরাপত্তা জোরদার করতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। ঢাকার বেশ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশও কাজ শুরু করেছে। নগরীর জেলরোড এলাকায় আমানত শাহ মাজারে আটটি ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে সিসিটিভি কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়।

মসজিদ কমিটি : মসজিদে জঙ্গিবাদের পক্ষে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা হয় কিনা তা যাচাই করছে পুলিশ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদের কমিটির লোকজন সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদ?ুল হক বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মসজিদ কমিটিতে জঙ্গিবাদ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থক আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। দেশব্যাপী প্রতিটি থানায় জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি গঠন হবে পুলিশ ও উলামাদের সমন্বয়ে। যেসব মাদ্রাসা ও মসজিদ কমিটি জঙ্গিবাদে মদদ দেয় সেই মদদদাতাদের চিহ্নিত করা হবে।

মন্দির ও ধর্মযাজকের ওপর হামলায় জেএমবি জড়িত : দিনাজপুরে মন্দিরে হামলা এবং ইতালীয় ধর্মযাজককে গুলির ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া এক ব্যক্তি। কাহারোল উপজেলায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া শরিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) বজলুর রশীদ গতকাল এ তথ্য জানান। এসআই বজলুর রশীদের ভাষ্য, শরিফুল নিজেকে জেএমবির সদস্য বলে স্বীকার করেছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ইসকন মন্দিরে হামলা এবং ধর্মযাজক পিয়েরো পিচমকে গুলির ঘটনা জেএমবি ঘটিয়েছে। ১০ ডিসেম্বর রাতে কাহারোলে ইসকন মন্দিরে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। হামলায় আহত হন দুজন। ঘটনা শেষে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতা শরিফুলকে ধরে ফেলে। পরদিন ভোরে বীরগঞ্জে একটি এ কে ২২ রাইফেলসহ মোছাব্বের নামে আরেক ব্যক্তিকে জনতা ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ জানায়, এ দুজন জেএমবির সদস্য। মন্দিরে হামলার ঘটনায় কাহারোল ও বীরগঞ্জ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। মামলা দুটির তদন্তভার ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই মামলায় ইতিমধ্যে শরিফুল ও মোছাব্বেরকে গ্রেফতার দেখিয়ে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেয় ডিবি।

এর আগে ১৮ নভেম্বর সকালে জেলা শহরের মির্জাপুর এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন গির্জার ধর্মযাজক ও চিকিত্সক ইতালির নাগরিক পিয়েরো পিচম। এ ঘটনায় শহর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মাহবুবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। দুই দফায় রিমান্ড শেষে তিনি এখন কারাগারে আছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর