রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ট রে ন্টো র চি ঠি

আর্থিক কেলেঙ্কারি আইএমএফ প্রধানের

শওগাত আলী সাগর

আর্থিক কেলেঙ্কারি আইএমএফ প্রধানের

‘আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিনা লাগার্দেকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে’— ফ্রান্সের আদালতের এ রায় ঘোষিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আইএমএফ বিবৃতি দিয়ে জানাল ‘শীর্ষ নির্বাহীর ওপর তাদের পরিপূর্ণ আস্থা আছে।’ শুধু তাই নয়, আইএমএফের মুখপাত্র গ্যারি রাইস ১৮৮টি সদস্য ও জাতিও আইএমএফ-প্রধানের ‘দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের সক্ষমতার’ প্রতি  আস্থাশীল বলে জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের আদালত আইএমএফ শীর্ষ নির্বাহীকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে রায় দেন। কোনো প্রতিষ্ঠান তার শীর্ষ নির্বাহীর পক্ষে দাঁড়াবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ আর দশটা সাধারণ প্রতিষ্ঠান বা করপোরেট হাউস থেকে আলাদা, তার কাজের পরিধিও ভিন্ন। ফলে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে ভাবনাগুলোও ভিন্নভাবেই শাখা-প্রশাখা মেলে। তার ওপর আইএমএফের শীর্ষ নির্বাহীর নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর মানদণ্ডের শর্তাবলির উল্লেখ থাকে। সেখানে আইএমএফের শীর্ষ নির্বাহীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে, তা-ও যদি আবার হয় আর্থিক দুর্নীতি তাহলে আমাদের ভুরু কোঁচকানোর যথেষ্ট যুক্তি থাকে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বিশ্বের দেশে দেশে সরকারগুলোর দুর্নীতি নিয়ে হল্লা চিল্লা করে বেড়ায়। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিয়ে সব সময়ই বড় বড় কথা বলে। অথচ নিজেদের দুর্নীতি নিয়ে মুখ বন্ধ করেই থাকে না, সাফাইও গাইতে শুরু করে। আইএমএফের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিনা লাগার্দের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক তদন্তও হয়েছে বেশ সময় নিয়ে। পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার সময় তাকে আইএমএফের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হয়নি। আর আদালত যখন তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন, আইএমএফ সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করল। তাহলে অন্যান্য দেশের দুর্নীতি নিয়ে আইএমএফের কথা বলার নৈতিক ভিত্তি থাকে কীভাবে? আইএমএফের পরিচালনা পরিষদ কি তাহলে সদস্য একটি দেশের আইন-আদালত তথা বিচারব্যবস্থাকে সম্মান করতে চায় না? ক্রিস্টিনা লাগার্দে একসময় ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ফ্রান্সের বিজনেস ম্যাগনেট ও টেলিভিশন তারকা বারনার্ড তাইপেকে ৪০০ মিলিয়ন ইউরো ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাইয়ে দিয়েছিলেন। বারনার্ড তাইপে ২০০৭ সালের ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিকোলাস সারকোজির পক্ষে কাজ করেছেন।

বারনার্ড তাইপে রাষ্ট্রায়ত্ত ‘ক্রেডিট লিওনাইস’-এর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন তাকে প্রতারিত করার অভিযোগ তুলে। তাতে তিনি দাবি করেন, কোম্পানির মূল্য কম দেখিয়ে ‘এডিডাস’-এ তার সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। তাতে তাইপে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্রিস্টিনা লাগার্দেই শেয়ার বিক্রির পুরো প্রক্রিয়াটি অনুমোদন দিয়েছেন। বারনার্ড তাইপের অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় ‘প্রাইভেট শালিসির’ মাধ্যমে। সে শালিসিতে স্থির হয়— রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ হিসেবে বারনার্ড তাইপেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দেবে। সে সময়কার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিনা লাগার্দে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাইপেকে এ অর্থটা পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। দীর্ঘ সময় ধরে সে অভিযোগের তদন্ত চলে। গত সেপ্টেম্বরে অবশ্য ফ্রান্সের আদালত পুরো অর্থ ফেরত দিতে বারনার্ড তাইপেকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই আদালত বৃহস্পতিবার ক্রিস্টিনা লাগার্দের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার নির্দেশ জারি করেছেন। আইএমএফ শীর্ষ নির্বাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচারকাজ চলছে ফ্রান্সের ‘কোর্ট অব জাস্টিস অব দ্য রিপাবলিক’-এ। ফ্রান্সের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত এবং বিচারের জন্য এ বিশেষ আদালতটি গঠিত হয়েছে। তদন্তের পুরোটা সময় ধরেই অবশ্য কোর্ট ক্রিস্টিনা লাগার্দেকে আলাদা একটি সম্মান দেখিয়েছেন। ‘আদালত ডাকা মাত্র হাজির হতে হবে’— এ শর্তে তাকে মামলায় সরাসরি অভিযুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করে ‘নিউট্রাল উইটনেস’ হিসেবে রেখেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তার বিরুদ্ধেও তদন্তের নির্দেশ দেন আাাদালত। এখন তো বিচারের মুখোমুখিই হতে হচ্ছে তাকে। বিচারের মুখোমুখি হতে আদালতের নির্দেশের মানে হচ্ছে আইএমএফের শীর্ষ নির্বাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়েছে। আদালত সে অভিযোগের বিচার করবেন। ক্রিস্টিনা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে নিজেকে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তিনি সব কিছু থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন। আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি অভিযুক্ত এবং একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিশেষ করে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে আদালতের বিচারাধীন আসামির আইএমএফের মতো গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ ধরে রাখা নৈতিকতার মানদণ্ডে কতটা গ্রহণযোগ্য— সে প্রশ্নও কিন্তু ওঠে। কেননা, ক্ষমতার সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার একটা ব্যাপার থাকে। ক্রিস্টিনা লাগার্দের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং আদালতের শুনানির পুরোটা সময়ই ফ্রান্স সরকার তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ফ্রান্সের শীর্ষ প্রসিকিউটর লাগার্দেকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক সুপারিশও করেছিলেন। শীর্ষ প্রসিকিউটরের সুপারিশ মানে হচ্ছে রাষ্ট্রের সুপারিশ। কিন্তু ফ্রান্সের আদালত রাষ্ট্রের সুপারিশকে বিবেচনায় নেননি। সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আইএমএফ-বসকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। ক্রিস্টিনা লাগার্দে বার বার নিজেকে নির্দোষ হিসেবে দাবি করে আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছেন। তবে অর্থমন্ত্রী থাকাকালের তার চিফ অব স্টাফ স্টিফেন রিচার্ড আদালতকে জানিয়েছেন, বারনার্ড তাইপেকে অর্থ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিটি প্রক্রিয়ায়ই ক্রিস্টিনা লাগার্দে অবহিত ছিলেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই সব কিছু হয়েছে এবং ক্রিস্টিনাই ছিলেন সে সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ফ্রান্সের টেলিকম জায়ান্ট ‘অরেঞ্জ’-এর কর্ণধার স্টিফেনও এ মামলায় একজন অভিযুক্ত। ফ্রান্সের আদালতের রায়ের পরপরই আইএমএফ যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে তা শোভন হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। বহুজাতিক এ সংস্থাটি যেহেতু সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারের দুর্নীতি, স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলে, এসব বিষয়ে কথা বলার নৈতিক শক্তিটিকে সমুন্নত রাখার স্বার্থেই বিচার প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আইএমএফ-এমডিকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। নিজেরা স্বচ্ছতার চর্চা না করে অন্যকে স্বচ্ছতার উপদেশ দেওয়াও তো শোভন কাজ নয়।

লেখক: টরন্টোর বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’-এর প্রধান সম্পাদক

সর্বশেষ খবর