শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

টাকা উড়ছে পৌরসভায়

জুলকার নাইন ও গোলাম রাব্বানী

টাকা উড়ছে পৌরসভায়

ভোটের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়েছে টাকা ছড়ানো। রীতিমতো ‘প্রার্থী’ কেনাবেচা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। টাকার বিনিময়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থীকেও ‘বসিয়ে’ দেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। কাউন্সিলর পদে সমঝোতার ঘটনা ঘটছে অহরহ। ভোট নিশ্চিত করতে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ক্লাবগুলোকে দেওয়া হচ্ছে টাকা। কেউ ধার ধারছেন না নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া ব্যয়সীমার। ভোটারদের টাকা দিতে নেওয়া হচ্ছে সব অভিনব কায়দা। জেঁকে বসা শীতকে ব্যবহার করা হচ্ছে টাকা বিলানোর মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে। শীতবস্ত্র বিতরণের কথা বলে ভোটার লিস্ট ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসছে এলাকার অচেনা মুখ। অবশ্য প্রবাস থেকে এসে সরাসরি ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীদের টাকা ওড়ানোতে নেই কোনো রাখঢাক। গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা, ভোট ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে টাকা ছড়াছড়ির ব্যাপকতা। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আমাদের দেশে অনেক কোটিপতি পৌরসভা চেয়ারম্যানের জন্য লড়াই করতে ইচ্ছুক হন। আবার এখানে উন্নয়নের টাকা বরাদ্দ থাকে এবং এ জায়গা থেকে টাকা পাওয়ারও উপায় থাকে। কাজেই নির্বাচনে টাকার প্রবাহ থাকবে এটা নির্বাচন কমিশনকে বুঝতে হবে। আর নির্বাচনে টাকার ব্যবহার যদি আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকে তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।

জানা যায়, নোয়াখালীর একটি পৌরসভায় বিএনপির এক মেয়র প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার আবেদন পান স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তা। কেন্দ্রীয় বিএনপি জোর করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগ তোলে। ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও যায়। কিন্তু কমিশনের কর্মকর্তারা যখন ঘটনাস্থলে তদন্তে যান, তখন আর সেখানে উপস্থিত হননি সেই আলোচিত প্রার্থী। সূত্রমতে, ক্ষমতাসীন দলের পৌর নির্বাচনে প্রার্থী নন এমন এক নেতার মধ্যস্থতায় বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী গোলাম কবিরের বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন বিএনপির প্রার্থী ফরিদুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশনের কাছে তার অভিযোগ, সরকারদলীয় প্রার্থী প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কর্মীদের হুমকি-ধমকির পাশাপাশি অর্থ দিয়ে ‘কেনা’র চেষ্টা করছেন। ভোট কেনার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি নির্বাচনী মাঠে ক্যাডারদের কাজে লাগাচ্ছেন। অর্থ ব্যয় করে বহিরাগতদের এনেছেন, পরিকল্পনা করছেন ভোট কেন্দ্র দখলের। অভিযোগ উঠেছে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী কবির আহমদদের বিরুদ্ধে। শনিবার তিনি স্থানীয় তেলিগুল এলাকার ৪ শতক জমি কবরস্থানের জন্য দিয়ে দেন। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে শীতবস্ত্র বিতরণের নামে অচেনা ব্যক্তিরা ভোটার লিস্ট ধরে ধরে অর্থসহায়তা করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে টাকা ও সম্পদ বিতরণের ঘটনা ধরা পড়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। শনিবার রাতে নাটোরের সিংড়া পৌরসভায় অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পৌর এলাকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটারদের মধ্যে টাকা বিলির সময় পৌর ওলামা দলের সভাপতি আতিকুর রহমানকে আটক করেন। তিনি বিএনপির মেয়র প্রার্থী শামীম আল রাজির পক্ষে টাকা বিতরণ করছিলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে দুই মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠান। সাতক্ষীরা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ওসমান গনি মিন্টুর শহরের ফুড গোডাউন মোড়ে ভোটারদের মাঝে গেঞ্জি বিতরণ করা দেখতে পেয়ে তাকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কমিশনের ‘পৌরসভা নির্বাচন আচরণ বিধিমালা’র ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে— কোনো প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে সংশ্লিষ্ট পৌরসভা এলাকায় কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো প্রকার চাঁদা বা অনুদান দিতে বা অঙ্গীকার করতে পারবেন না। ১৭ নম্বর ধারায় ভোটারদের কোনোরকম পানীয় বা খাদ্য বা উপঢৌকন, বকশিশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্বাচন প্রস্তুতি বৈঠকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে পৌরসভা নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ির শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভোট গ্রহণের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, বড় দলগুলোর মধ্যে তত কোন্দল বেড়ে যেতে পারে। এ নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে। এসব প্রতিরোধে চলমান সন্ত্রাসবিরোধী তত্পরতা জোরদার করতে হবে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ৪৭ জন (৫.১৯%)। আওয়ামী লীগের ২২১ জন প্রার্থীর মধ্যে এ সংখ্যা ২০ (৯.০৪%), বিএনপির ২০৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৩ জন (৬.৩১%)। বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগে বেশি হলেও, কম সম্পদের মালিক আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতে বেশি। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের জোট ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেছেন, শুধু ভোট কেনাই নয়, নির্বাচনী প্রচারণার জন্য যে বরাদ্দ আছে তা-ও ঠিকমতো মানা হয় না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উদাহরণ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিছু প্রার্থীর অতিরিক্ত টাকা খরচ করার কারণে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়েছে বা নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ থাকলে নির্বাচনে প্রচুর টাকা খরচের বিষয়টি সম্পর্কে প্রার্থীও সচেতন হতেন। ইসির এ বিষয়ে কাজ করা এবং ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কোনো অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেউ টাকা ছড়ানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া আচরণবিধি দেখভালের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে কাজ করছেন। তারা প্রমাণ পেলে তত্ক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর