বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

টানাপড়েনে দুই দল

নির্দেশ না মানা এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে

রফিকুল ইসলাম রনি

টানাপড়েনে দুই দল

কেন্দ্রের নির্দেশ মানেননি আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্য (এমপি)। আজকের পৌরসভা নির্বাচনে অন্তত অর্ধশত বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে রেখেছেন তারা। নিজস্ব বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে রাখা এমপিদের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সাবেক মন্ত্রীও রয়েছেন। দলীয় নির্দেশ অমান্যকারী এমন দেড় ডজন এমপিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের একজনকে বহিষ্কার এবং আরেকজনকে শোকজ করা হয়েছে। নির্বাচনের পর অমান্যকারী বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের  বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, দলের নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীকে মদদ দেওয়ার কারণে সর্বশেষ শোকজ করা হয়েছে সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এমপিকে। নির্বাচনের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ভালুকার এমপি সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে। ছাড় পাবেন না অন্যরাও। বিদ্রোহীদের মদদদাতাদের তালিকা করে সতর্ক করার পরও যে মন্ত্রী-এমপিরা দলের নির্দেশ মানেননি তাদের ওপর প্রধানমন্ত্রী নাখোশ। আজকের নির্বাচনে দলের মনোনীত মেয়র প্রার্থীর পরাজয় হলে চড়া মূল্য দিতে হবে বিদ্রোহীদের মদদদাতা এমপি-মন্ত্রীদের। জানা গেছে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শাহনেওয়াজ শাহেনশা। এতে নাখোশ হন জামালপুর-১ আসনের এমপি এবং সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তিনি মেয়র প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন তার ভাতিজা নুরুন্নবী অপুকে। কিন্তু ভাতিজা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগের এই এমপি। এ কারণে তাকে গত রবিবার শোকজ করা হয়েছে। জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট বাকী বিল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জামালপুর-১ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদ দলীয় মেয়র প্রার্থী শাহনেওয়াজ শাহেনশার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তার ভাতিজা বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুন্নবী অপুর পক্ষে নির্বাচনে কাজ করছেন। একই সঙ্গে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নেতা-কর্মীদের  ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে প্রভাবিত করছেন। এ অবস্থায় দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে কেন এমপি আবুল কালাম আজাদকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হবে না এই মর্মে জেলা আওয়ামী লীগ সাত দিনের মধ্যে তাকে কারণ দর্শাতে বলেছে। ময়মনসিংহের ভালুকা পৌরসভা মেয়র পদে স্থানীয় এমপি ডা. আমান উল্লাহর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন তার নিজস্ব লোক হিসেবে পরিচিত সাদিকুর রহমান তালুকদার। কিন্তু দল থেকে মনোনয়ন পান ডা. কাইয়ুম। এতে নাখোশ হন এমপি ও তার অনুসারীরা। পুরো নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় এমপির সমর্থকরা ছিলেন নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে। দু-একজন মাঠে নামলেও তা ছিল নিছক লোকদেখানো। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার এমপি আমান উল্লাহ ভালুকায় গিয়ে উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, নৌকার প্রার্থী পাস করল না ফেল করল তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভালুকা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ডা. কাইয়ুম মেয়র নির্বাচিত হলে এমপির রাজত্ব কমে আসবে। তাই যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করতে উঠেপড়ে লাগেন এমপি আমান উল্লাহ। এমপির এক ভাতিজা এলাকায় স্লোগান দেন, ‘আমি এমপির ভাতিজা খাজা ভাই, নৌকা মার্কায় ভোট চাই-না দিলেও ক্ষতি নাই’। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ময়েন খান। সেখানে দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন কারিবুল হক রাজিন। এই বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয় এমপি গোলাম রাব্বানী। এ কারণে তাকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। নীলফামারীর জলঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল ওয়াহেদ বাহাদুর। বাহাদুর এক সময়ে স্থানীয় এমপি গোলাম মোস্তফার বিরোধী পক্ষে ছিলেন। কিছুদিন ধরে তিনি এমপির পক্ষে অবস্থান করলেও তাকে সমর্থন করছেন না এমপি। তিনি বাহাদুরের বিরুদ্ধে গোপনে প্রার্থী করেছেন বর্তমান মেয়র ইলিয়াস হোসেন বাবলুকে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বিদ্রোহী প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহিম স্থানীয় এমপি হাসিবুর রহমান স্বপনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কয়েক দিন আগে স্বপনকে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে ডেকে কথা বলেন। তবে তার অনেক অনুসারী এখনো বিদ্রোহীর পক্ষে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বর্তমান মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। স্থানীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। কিছুদিন আগে শিশু সৌরভকে গুলির ঘটনায় এমপি লিটনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মামুন। এ প্রেক্ষাপটে লিটন বিদ্রোহী প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চঞ্চলকে সমর্থন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ মামুনের। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভায় দল মনোনীত প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের শেষ পর্যন্ত সমর্থন পাননি স্থানীয় এমপি আবু রেজা নদভীর। প্রকাশ্যে না এলেও তিনি ভিতরে ভিতরে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করছেন বলে অভিযোগ ওঠে। চট্টগ্রামের রাউজানে দেবাশীষ পালিত দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় নাখোশ হয়েছেন চট্টগ্রাম-৬ আসনের এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। এমপির পছন্দের প্রার্থী রাউজান পৌরসভার বর্তমান মেয়র শফিকুল ইসলাম বেবী। প্রথমে বেবীর ছেলেকে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করালেও পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে নিষ্ক্রিয় করা হয় তাকে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী মীর মুনসুর আলমকে সমর্থন করছেন এমপি ফজলে করিম।

নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে কালিয়া পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মুশফিকুর রহমান লিটনকে সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে। শনিবার মুক্তির কার্যালয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর অনুসারীরা। জানা গেছে, কয়েক দিন আগেই মুক্তিকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বলেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু তার নির্দেশনা আমলে নেননি মুক্তি।

ধানমন্ডিতে থাকবে মনিটরিং টিম : আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ওবায়দুল কাদের ও সমন্বয় কমিটির সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সারা দেশে মনিটরিং টিমের তত্ত্বাবধায়ন  করবেন। ভোট পর্যবেক্ষণের জন্য সাত বিভাগে পৃথক সাতটি সেল খোলা হয়েছে। দলের সাত সাংগঠনিক সম্পাদক নিজ নিজ বিভাগের জেলা-উপজেলা নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করবেন। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে দুপুর ১টায় এবং সর্বশেষ বিকাল সাড়ে ৪টায় দুটি সংবাদ সম্মেলন করবেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

সহযোগিতার নির্দেশ নেতা কর্মীদের : অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে মানুষের ভোট দেওয়া নিশ্চিত করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল বিকালে দলীয় সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতা-কর্মীদের এ নির্দেশ দেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না কোনো অনিয়ম কিংবা ত্রুটি করে নির্বাচন বিতর্কিত করা হোক। কারণ ইতিমধ্যে বিএনপি নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। আমাদের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশ থাকবে, আজকের পৌরসভা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং সবাই যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারে এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবেন।’ মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘ভোটারদের কাছে আমাদের একটি আহ্বান আছে। যদিও এ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হবে না। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দেবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার মার্কা, আস্থার মার্কা, উন্নয়নের প্রতীক এ দেশের স্বাধীনতার প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, জনগণ উন্নয়ন, অগ্রগতি চায়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে চায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। আর সেই ধারা অব্যাহত রাখতে সবাই নৌকা প্রতীকে ভোট দেবে।’ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক, ড. আবদুর রাজ্জাক, আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, আবদুল মান্নান খান, ডা. বদিউজ্জামান ভূঁইয়া ডাবলু, অসীম কুমার উকিল, এনামুল হক শামীম, সুজিত রায় নন্দী, লিয়াকত শিকদার, যুবলীগের হারুন অর রশিদ, যুব মহিলা লীগের নাজমা আক্তার, অপু উকিল প্রমুখ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর