সোমবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেউলিয়া হওয়ার পথে যমুনা ব্যাংক

আলী রিয়াজ

দেউলিয়া হওয়ার পথে যমুনা ব্যাংক

অনিয়ম, জালিয়াতির কারণে দেউলিয়া হতে বসেছে যমুনা ব্যাংক। একের পর এক ঋণ জালিয়াতি ঘটনা ঘটছে ব্যাংকটিতে। বিসমিল্লাহ গ্রুপকে দেওয়া প্রায় ২০০ কোটি টাকা এখন পর্যন্ত আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকটির জালিয়াতি থেমে নেই। ভুয়া বিল, ভাউচার তৈরি করে প্রতিবছর কোটি টাকার বেশি আত্মসাত্ করছেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারির মাধ্যমে পাচার করা টাকা উদ্ধার না করে দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বহাল রেখেছে ব্যাংকটি। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কূটকৌশলে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হচ্ছে। ফলে দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে। যমুনা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি। এর একটি বড় অংশ পুনঃতফসিলকৃত হওয়ায় এগুলোও খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। শত শত কোটি টাকা ঋণ আদায় করতে না পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিপুল পরিমাণ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে চলছে যমুনা ব্যাংক। ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে নিজেরাই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় নতুন কোনো বিনিয়োগে যেতে পারছে না বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যমুনা ব্যাংকের শুধু গত বছরই প্রভিশনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার দরও অভিহিত মূল্যে লেনদেন হচ্ছে। আর্থিক অবনতির কারণে ব্যাংকের দৈনন্দিন খরচও মেটাতে পারছে না। নানা অনিয়মে জড়িয়ে ব্যাংকটি এখন মূলধন ঘাটতির পথে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। পরে গত জুন মাসে ব্যাংক বিশেষ সুবিধা দিয়ে বেশিরভাগ খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই খেলাপির একটি বড় অংশ এর পর্ষদ সদস্যদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া। ২০১৫ সালে ব্যাংকটি মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৬০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। যার বড় অংশই পুনঃতফসিল করা, সেগুলোও নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েছে। শুধু বিসমিল্লাহ গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১৬৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। দুই বছর আগে যমুনা ব্যাংকের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখায় ১০৬ কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ায় এ নিয়েও ব্যাংক খাতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ২০১১ সালে ঢাকার কয়েকটি শাখায় খোলা ১৩টি এলসির বিষয়েও নতুন করে অনুসন্ধান করেছে দুদক। এর মধ্যে দুটি এলসির টাকা প্রায় দেড় বছর পর পরিশোধ করা হলেও বাকি ১১টি এলসির বিপরীতে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ২২ হাজার ২৪৮ টাকা আত্মসাত্ করেছে ব্যাংকটির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মোট ৮ কোটি টাকা মূল্যের এলসির টাকা জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে আত্মসাত্ করেন। এরপরেও একের পর এক ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে ঋণের কিছুটা লাগাম টানা সত্ত্বেও এক টাকাও খেলাপি আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। প্রতিবছর বাড়ছে তাদের মন্দ ঋণের পরিমাণও। ফলে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভিশনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। খেলাপি ও মন্দ ঋণের কারণে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকটি। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন উত্স থেকে নিজেরাই ঋণ করে চলছে। গত বছর যমুনা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪৪ কোটি টাকা। আগের বছর ঋণ করেছিল প্রায় সাড়ে ৯৫০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি মুনাফা দেখিয়েছে ৬৯ কোটি টাকা। মুনাফার চেয়ে বেশি খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন রেখেছে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে গ্রাহকদের মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বেশিরভাগ গ্রাহকরা তাদের ডিপোজিট উত্তোলন করে নিচ্ছে। যমুনা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ বছর ডিপোজিট সংগ্রহ করেছে ৫৭৪ কোটি টাকা। আগের বছর যা ছিল ৭২৮ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির ডিপোজিটের পরিমাণ কমেছে ১৫৪ কোটি টাকা। শুধু ঋণ জালিয়াতি নয়। ব্যাংকের কেনাকাটার নামে বিভিন্ন ভুয়া বিল, ভাউচার তৈরি করে পর্ষদ সদস্যরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত এক বছরে ১০০৫ কোটি টাকার কেনাকাটা করেছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে ব্যাংকের পরিচালকরা বিভিন্ন ভাতা বাবদ প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কেনাকাটার মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ার পরিস্থিতিও খুবই নাজুক। গত এক বছর ধরেই শেয়ার দর অভিহিত মূল্যে লেনদেন হচ্ছে ব্যাংকটির। ২০১০ সালে ভয়াবহ দরপতনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ উপেক্ষা করে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করায় যমুনা ব্যাংক কয়েক কোটি টাকা লোকসান দেয়। এর প্রভাব থেকে এখনো বের হতে পারেনি তারা। প্রভিশন, খেলাপি ও মন্দ ঋণ ছাড়াও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে মূলধন হারাতে বসেছে ব্যাংকটি। জানতে চাইলে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খারাপ ঋণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রভিশন রাখা হয়। ব্যাংকের মুনাফা থেকেই আমরা প্রভিশন রেখেছি। এটা বৃদ্ধি পাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। ঋণ আদায়ে ঘাটতি বা অনিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, আমাদের ঋণ আদায় বা বিনিয়োগে কোনো ঘাটতি নেই। তবে কিছু ঋণ মন্দ হয়েছে। এ ছাড়া যমুনা ব্যাংকের ঋণ প্রদানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। এখনো স্প্রেড (ঋণ-আমানতের সুদের পার্থক্য) বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের পরও ৫ শতাংশের বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়াদি ঋণে পার্থক্য খুব বেশি নয়। ১৩ শতাংশের বেশি সুদ দিয়ে কেউ ঋণ নেবে না। এরপরেও স্প্রেড কমানোর চেষ্টা আমরা করছি।

সর্বশেষ খবর