শুক্রবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

জোট নিয়ে টানাপড়েনে বিএনপি

শফিউল আলম দোলন ও মাহমুদ আজহার

পৌরসভা নির্বাচনে ২০-দলীয় জোটের শরিক এলডিপি ও কাজী জাফরের জাতীয় পার্টিকে মাত্র দুটি মেয়র পদ ছাড় দেয় বিএনপি। জোটের প্রধান শরিক জামায়াতকে একটিতেও ছাড় দেওয়া হয়নি। নামসর্বস্ব অন্য শরিকদের চাওয়া-পাওয়াকেও গুরুত্ব দেয়নি বিএনপি। পরে প্রচারে যাওয়া নিয়ে জোটের মহাসচিব পর্যায়ে এক বৈঠকে তোপের মুখে পড়েন বিএনপির দুই নেতা। বৈঠকে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট অংশ নেয়নি। শরিক দলের মহাসচিব পর্যায়ের এক নেতা বলেই ফেলেন, প্রার্থী দেওয়ার সময় ডাকা হলো না। এখন প্রচারণায় কেন জোট নামবে। এ নিয়ে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। এতে টানাপড়েনে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে জনসভা করে বিএনপি। সেখানেও জোটের শরিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জোটের বেশ কয়েকজন নেতা। তারা বলেন, ৫ জানুয়ারি শুধু বিএনপিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, জোটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নানা প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে জোট ভাঙারও চেষ্টা ছিল। এরপরও দুর্দিনে তারা জোট ছেড়ে যায়নি। এখন কেন এত অবমূল্যায়ন?তবে গতকাল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ৫ জানুয়ারি বিএনপি দলগতভাবে কর্মসূচি পালন করে। সরকারের বাধায় দুই বছর ধরে বিএনপি রাজপথে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এ জন্য দলের শক্তির বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়ার জন্যই এ ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে জোটের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো ঘাটতি হবে না। ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের বড় একটি অংশের মতবিরোধ ছিল। তারা বিএনপি জোটের সঙ্গে আছে ও থাকবে। জানা যায়,  বেশ কিছুদিন ধরেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে বড় শরিক দল জামায়াতসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির চরম টানাপড়েন চলছে। সম্প্রতি জামায়াতের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতাসহ চেয়ারপারসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা দুর্ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ করেছে জামায়াত। সম্প্রতি জোটের শরিকদের গুরুত্ব না দেওয়া, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার, পৌর নির্বাচনে অবমূল্যায়ন ও ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি পালনে জোটকে না ডাকায় ক্ষুব্ধ শরিক দলের নেতারা। ছোট ছোট আরও দু-একটি শরিক দল জোট ছাড়ার কথাও ভাবছেন। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগও চলছে বলে জানা গেছে। এদিকে, ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বিএনপির বড় ধরনের এ কর্মসূচিতে শরিকদের কারও না থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় উচ্চ আদালতে বহাল রাখার প্রতিবাদে দলটি সারা দেশে হরতাল করেছে গতকাল। এ প্রসঙ্গে মহানগর জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা বলেন, আমাদের দলের সর্বোচ্চ নেতার ফাঁসির রায় হয়েছে। আমরা এখন সেটি চিন্তা করছি। বিএনপি নিয়ে আপাতত চিন্তা করার সময় নেই। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির সঙ্গে জোটের শরিক দলগুলোর টানাপড়েন চলে আসছে। এর আগেও জোটের মহাসচিব পর্যায়ের একটি এবং শীর্ষ নেতাদের একটি বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপিসহ বেশির ভাগ শরিক দলই যোগ দেয়নি। বিশেষ করে ৩০ ডিসেম্বর রাতে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে নামসর্বস্ব দল ছাড়া জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপিসহ পরিচিত দলের একটিও যোগ দেয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার এসব শরিক দলের ছোট ছোট ক্ষোভ ও মনোমালিন্য বিস্ফোরণ ঘটতে শুরু হয়েছে। দুই বছর আগে জোট ছেড়েছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) শেখ শওকত হোসেন নিলু ও ন্যাপ ভাসানীর শেখ আনোয়ারুল হক। এ ছাড়াও  জোট ছাড়েন ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবদুর রশিদ প্রধান ও এনডিপির মহাসচিব আলমগীর মজুমদার। এবার ছাড়লো মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর ইসলামী ঐক্যজোট। জোট ছাড়া নেতারা জানান, বিএনপির অবহেলা, অবমূল্যায়ন ও দলের কয়েকজন নেতাসহ চেয়ারপারসন কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তার অসদাচরণ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতার কারণেই শরিকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেন, সংখ্যার দিক থেকে আমরা বিএনপির চেয়ে ছোট, এটা জেনেই আমাদের জোটে নেওয়া হয়েছে। আমাদের নাম ব্যবহার করা হয়, সংগঠনের নাম ব্যবহার করা হয়। মামলা-হামলা সহ্য করে মিটিং-মিছিলে কমবেশি নেতা-কর্মী নিয়ে অংশ নিতে হয়। অথচ চেয়ারপারসন কার্যালয়ে গেলে খারাপ আচরণ করা হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে বলা হয় তিনি খুব ব্যস্ত, আজ আর দেখা হবে না।  বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, জোটের চাহিদা ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাহিদা মুখোমুখিভাবে যতক্ষণ পরিপূরক ও সম্পূরক ততক্ষণ জোট ভাঙবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মেরুকরণ শুরু হয়েছে। জোটে আগমন ও নির্গমন শুরু হয়েছে। তবে জোটের প্রধানতম শরিক দলের চাহিদার সঙ্গে অন্যদের মানিয়ে নেওয়াই উত্তম। আমরা জোটে আছি, থাকব। এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, এলডিপির ওপর এমন কোনো চাপ নেই যা দেওয়া হয়নি। এরপরও এলডিপি জোটে আছে, থাকবে। ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসে জোটকে সঙ্গে নিয়েই কর্মসূচি পালন করা উচিত ছিল। অন্তত জোটকে আস্থায় নিয়ে আসা জরুরি ছিল। এ কারণেই হয়তো কারও মান-অভিমান থাকতে পারে। তবে জোট ছাড়ার চিন্তা করা ঠিক হবে না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ এ অবস্থাকে ২০-দলীয় জোট ভাঙার ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, জোটের বিভিন্ন শরিক দলকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র সফল হবে না। তবে ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের বাংলাদেশ লেবার পার্টি, মুফতি ওয়াক্কাসের জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামী, জেবেল রাহমান গানির বাংলাদেশ ন্যাপের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, জোট ছাড়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ নানা প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি হুমকি-ধমকিও আসছে। এ প্রসঙ্গে ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জোট ভাঙেনি, ভেঙেছে ইসলামী ঐক্যজোট। আমরা দেশ রক্ষা ও মানুষ বাঁচানোর সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে জোট করেছি। তা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যত রকমের জেল-জুলুম বা নির্যাতন আসুক না কেন জোট ছাড়া সম্ভব নয়।

সর্বশেষ খবর