সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

বিস্মৃতিপ্রবণ বাংলাদেশি

আমীর খসরু

বিস্মৃতিপ্রবণ বাংলাদেশি

‘বাংলাদেশের মানুষ খুব অল্পতেই অতীত ঘটনাবলি ভুলে যায়’—কথাটি আমার নয়। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়কালে ঢাকায় দায়িত্বপালনকারী পশ্চিমা দেশের একজন রাষ্ট্রদূত তার বিদায়ের প্রাক্কালে এই মন্তব্যটি করেছিলেন। আমি ওই রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। সাক্ষাত্কারে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল। ওই সাক্ষাত্কার শেষে আন্তরিকভাবে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এ দেশ সম্পর্কে আসলে তিনি কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, বিশেষ করে এখানকার সাধারণ মানুষ সম্পর্কে— যা অন্য দেশ থেকে আলাদা। তিনি ওই দিন আমার ওই প্রশ্নের জবাবে তেমন কিছুই বললেন না, তবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এ দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে, তাদের হূদ্যতা এবং আতিথেয়তার কথা। কিন্তু বললেন, প্রশ্নের জবাব তিনি আমাকে অবশ্যই দিয়ে যাবেন। তিনি সম্ভবত ওই সাক্ষাত্কারকালে রেকর্ডারসহ যন্ত্রপাতি দেখে আসল কথাটি বলতে চাননি। রাষ্ট্রদূতরা সাধারণত বিদায়ী একটি পার্টি দিয়ে থাকেন। ওই রাষ্ট্রদূতও অতি অল্পকালেই এমনটি করেছিলেন। তাতে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। পার্টিতে যাওয়ার পরে তার সঙ্গে কুশলবিনিময় হলো। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘আপনি ওই দিন একটি প্রশ্ন করেছিলেন’। আমি হ্যাঁ বলতেই তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশিরা খুব সহজেই সদ্য অতীত ঘটনাকেও ভুলে যায়— এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে’। আমি বললাম, আপনি কি বলতে চাইছেন বিস্মৃতিপ্রবণ। তিনি বললেন, না তা ঠিক নয়, এটাই সম্ভবত পুরো সমাজে ঢুকে গেছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও বললেন, এত ঘটন-অঘটনের মধ্যে এটাই সম্ভবত স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এর কিছুকাল আগে আরেকটি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম ওই একই উদ্দেশে অর্থাত্ বাংলাদেশ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে। একই প্রশ্ন করলাম, তবে সাংবাদিকতায় যাকে বলে ‘অব দ্য রেকর্ড’। অবশ্য এর আগে ওই দুই সাক্ষাত্কারেই একই প্রশ্ন করা হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে, জবাবও মিলেছে আনুষ্ঠানিক। এই দফায় ওই রাষ্ট্রদূত জবাব দিলেন, একজন কূটনীতিকের ভাষায়। তবে অনানুষ্ঠানিক জবাবটি দিলেন রেকর্ডারসহ যন্ত্রপাতি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলার পরে। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে বললেন, ‘দেখুন বাংলাদেশ হচ্ছে রিউমার বা গুজবের জন্য একটি ‘ইউনিক প্লেস’। কারণ অনেক খবরাখবর আমি বা আমরা পেয়েছি গুজবের মাধ্যমে— যা আপনাদের সংবাদপত্রের পাতায় বা সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যায় না। অতিরঞ্জন হলেও অনেক গুজব আছে, যা ভালোভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসে’। সাংবাদিকতার কারণে দেশি-বিদেশি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ থেকে অতি সাধারণ মানুষের সঙ্গেও কথা বলতে হয়, যোগাযোগ রাখতে হয়। এমনটা বহুবার করতে হয়েছে এবং এখনো করছি। তবে ওই দুটি মন্তব্য এখনো আমার মনে দাগ কেটে আছে।

২. বিস্মৃতি প্রবণতার বিষয়টি যদি আলোচনা করি তাহলে বলতেই হবে এই সেদিনের অর্থাত্ ২০১৫-তে ঘটে যাওয়া বহু বড় বড় ঘটনা এখন আমরা ভুলে গেছি বা আমাদের ভুলতে বাধ্য করা হয়েছে। ওই বছরটিতে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশ্য হামলা করা হয়েছে একজন প্রকাশকসহ কয়েকজন ব্লগারকে। বেশ কিছু সাংবাদিকও সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দুজন বিদেশিকেও হত্যা করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে একজন ইতালীয় নাগরিকসহ বেশ কয়েকজনকে। শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মিছিলে গ্রেনেড হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। একাধিক হিন্দু মন্দিরে হামলা, একজন খ্রিস্টান যাজককে হত্যার চেষ্টাসহ খ্রিস্টান যাজকদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, বোমা হামলা হয়েছে আহমদিয়া মসজিদে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো যেমন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল-কায়েদা ভারতীয় শাখাসহ অনেক সংগঠনের নাম আগে আমরা শুনেছি, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি এরা আমাদের ঘরেই ঢুকে পড়েছে। হত্যার দায়ও স্বীকার করছে। সরকার কোনো তদন্তের আগেই বলে দিচ্ছে, এ দেশে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সরকার আইএস বা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন নেই বলে যতটা সময় ব্যয় করছে, ওই সব হত্যাকাণ্ড অথবা হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো আন্তরিকতা দেখায়নি। বিস্মৃতিপ্রবণ না হলে সংবাদ মাধ্যমসহ আমরা জানতে চাইতাম, ‘ওই সব ঘটনায় জড়িতরা কি ধরা পড়েছে, মিলেছে কি তাদের সন্ধান’? কিন্তু সবাই চুপচাপ। এমনকি মাত্র সেদিন চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানা থেকে যে অত্যাধুনিক অস্ত্রটি উদ্ধার করা হলো এবং গোপন আস্তানায় পাওয়া গেল পুলিশের অতি গোপনীয় নথি— তা কেমন করে ও কোথা থেকে এলো সে বিষয়েও তো কোনো প্রশ্ন নেই। নেই কোনো উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা। এমনকি জানার ইচ্ছেটুকুও নেই। কখনো যদি কেউ অতি উত্সাহী হয়ে জানতে চায় তাহলে জবাব মেলে সেই গত্বাঁধা কথা— ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’। এই নিরাপত্তা স্বার্থটি কাদের? নিরাপত্তা যদি সাধারণ মানুষের না হয়ে গুটি কয়েকের হয়, অবশ্য হয়েছেও তাই— তাহলে বলার কিছু নেই। বলার কিছু নেই এই কারণে যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন তদন্তের আগেই বলে দেওয়া হয়— অমুক জড়িত, ওই দল জড়িত তা হলে? জড়িত থাকার যদি প্রমাণাদি থেকেই থাকে তাহলে এত দেরি কেন? তাও কি ওই নিরাপত্তার স্বার্থেই? এ তো গেল একটি দিক। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা আছে, যা আমরা বিস্মৃত তো হয়েছিই বা সোজা কথায় বলতে গেলে বিস্মৃতিতে বাধ্য করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজন, রক্ত সম্পর্কের ব্যক্তিরা রাস্তায় গুলি করে রিকশাওয়ালাসহ সাধারণ মানুষ মেরেছে, মানুষ চাপা দিয়েছে— সে সবেরই বা খবর কী? গুম, অপহরণ, কথিত গণপিটুনি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও কি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে? না ভীতির সংস্কৃতি দিয়ে মন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে। শুধু এসব ঘটনাই যে আমরা ভুলে গেছি তা নয়, আমাদের স্মৃতির আড়ালে চলে গেছে শেয়ারবাজার লুটপাট, বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ লুণ্ঠন যেমন— হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংকের নানা অপকর্মগুলো। ভুলে গেছি নির্বাচন কমিশনে প্রদত্ত ক্ষমতাসীনদের সম্পদের তালিকায় একেকজনের সম্পদের পাহাড়সম স্ফীতির কথা। এভাবে আরও কিছুটা পেছনে গেলে দেখা যাবে কত শত ঘটনা আমরা ভুলে গেছি বা আমাদের ভুলতে বাধ্য করা হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমরা ভুলে গিয়ে এখন সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি পৌরসভা নির্বাচনে কতটা কারচুপি হয়েছে কি হয়নি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এবারের ৫ জানুয়ারিতে কেন এত ভদ্র ও সুশৃঙ্খল আচরণ করল ইত্যাকার বিষয়গুলো এখন টকশোসহ সবকিছুর আলোচনায়। আর এটা যে করা হচ্ছে কৌশলে, ইচ্ছাকৃতভাবে তাই বা আমরা কজন বুঝি। পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, আমরা অতি সহজেই ভুলে যাই। সম্ভবত একজন রাষ্ট্রদূত ওটুকুই বলতে পারেন তাদের কূটনৈতিক চাকরির সীমাবদ্ধতার কারণে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আসলেই ভুলে যাই, না রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা আমাদের ভুলতে বাধ্য করে, ভুলিয়ে দেয় জোর করে ও কৌশলে। আর গুজবের প্রসঙ্গটি নিয়ে কিছু বলা সম্ভব হবে না সঙ্গত কারণেই।

তবে এটুকু বলতে চাই, অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ গুজব তৈরির জন্য উত্তম পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অর্থাত্ নিয়ন্ত্রণ গুজব তৈরির কারখানা। তবে একটি বিষয় স্বীকার করতেই হবে, ভুলিয়ে দিয়ে বা ধামাচাপা দিয়ে রাখার মাধ্যমে আসল সমস্যাকে জিইয়ে রাখলে তা ভবিষ্যতে ভয়াবহ সংকটেরই জন্ম দেয়। যার আলামত আমরা পেতে শুরু করেছি।

লেখক : সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম

সর্বশেষ খবর