শিরোনাম
বুধবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গি দমনে সমন্বয়হীনতা

সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও সংকট রয়েছে

সাখাওয়াত কাওসার

জঙ্গি দমনে সমন্বয়হীনতা

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে চলছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। নাশকতা কিংবা জঙ্গি কর্মকাণ্ড রুখতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনাও। প্রযুক্তিগত দিক, গোয়েন্দা তথ্যসহ অপারেশনাল অনেক বিষয়েই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। জঙ্গি অর্থায়ন ঠেকাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পদক্ষেপ। সম্প্রতি প্যারিস এবং জাকার্তায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হামলার পর থেকে এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন গোয়েন্দারা। তবে জঙ্গি দমনের কাজে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন খোদ সংশ্লিষ্টরাই। জনবলের ঘাটতিসহ আটক জঙ্গিদের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না করাসহ সংশ্লিষ্টদের অনেকে এটিকে সমন্বয়হীনতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ সত্ত্বেও জঙ্গি দমনের মতো বিশেষ উদ্দেশে গঠন করা এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) নিজেদের যথেষ্ট প্রস্তুতির কথা বলেছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, দেশে  কোনো আইএসের তত্পরতা নেই। তবে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলো ছোট ছোট দলে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গিবাদ প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকারবিষয়ক একটি বিশেষ সেল গঠন করে। সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে সেলের সদস্য করা হয়। সেলের অন্যতম সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচার চালানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এমনকি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি, স্বীকৃতি নবায়ন ও শাখা অনুমোদনের ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম চালানো বাধ্যতামূলক করা হয়। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম না চালালে ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করার নির্দেশ রয়েছে। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব কার্যক্রম পুরোপুরি পালিত হচ্ছে না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্পষ্ট অবস্থান খুব জরুরি। কারণ তাদের অবস্থান অনেকটাই দোদুল্যমান। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আইএসের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পর আমাদের এ বিষয়টি নিয়ে আরও বিশেষভাবে ভাবার সময় এসেছে। কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সীমাবদ্ধ না থেকে সরকারের উচিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করা। সাখাওয়াত আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব হয়। সে জন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি। একই সঙ্গে ইন্টেলেকচুয়াল ব্যক্তিবর্গ ও সিভিল সোসাইটিকে এক করে শর্ট টার্ম এবং লং টার্ম পরিকল্পনা করে কাজ করা উচিত। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে শুধু সাময়িক প্রভাব ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু গোপনে গোপনে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করবেই। এখন মাদ্রাসার ছাত্রদের  চেয়ে অনেক উচ্চশিক্ষিত আধুনিক তরুণ জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ছে। কেন তারা জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি তৎ?পরতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের নতুন ছক গড়ে ওঠায় বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে। ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে এখানকার জঙ্গিরা নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। আগে আল-কায়েদার অনুসারী ছিল জঙ্গিরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জঙ্গিদের সঙ্গেও বাংলাদেশের জঙ্গিদের সম্পর্ক অনেক পাকাপোক্ত। গত বছরের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে এক বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশের জেএমবির অনেক সদস্য পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে থেকে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। এ ঘটনার পর কয়েক দফা ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনআইএ) কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জঙ্গিদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তথ্য বিনিময় করেছেন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সংযোজন করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। পুলিশের তরফ থেকে স্থাপন করা হয়েছে সাইবার ল্যাব। এমন প্রযুক্তি রয়েছে র‌্যাবসহ অন্য সব গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে। জঙ্গিবাদ দমনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে পর্যাপ্ত উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে। সেসব প্রযুক্তি পুরোদমে কাজে লাগানো হচ্ছে। র‌্যাবে নতুনভাবে সংযোজিত অপরাধীদের ডাটাবেজকেও জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে। এর বাইরে মূলত জঙ্গি দমনকে সামনে রেখেই ঢাকা মহানগর পুলিশে গঠন করা হয়েছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। খুব শিগগিরই বিশেষায়িত এই ইউনিটটি কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তবে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জঙ্গি ইউনিটগুলোর উচিত হবে সমন্বিতভাবে কাজ করা। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে এর তেমন একটা সুফল আসবে না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে জঙ্গিরা খুব চাপে রয়েছে। কোনোভাবেই তারা সুবিধা করতে পারছে না। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিরসন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়াতে হবে। মনিরুল আরও বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিরিয়া এবং ইরাকে আইএসের তৎ?পরতা এখানকার জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করছে। এখন ‘লিডারলেস’ জিহাদ শুরু হয়েছে। ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ব্যাপারে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে শুধু জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করবে এমন কোনো ইউনিট নেই। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট হলে সেখানে যারা থাকবে সেখানে কর্মরতরা মাসের পর মাস শুধু জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করবে এবং জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভের কারণগুলোও অনুসন্ধান করবে। এতে সুফল পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলে জঙ্গি অর্থায়ন ঠেকাতে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর ওপর নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। জঙ্গি অর্থায়ন ঠেকাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি সেক্টরে বিশেষ সেল রয়েছে। সেসব  সেল দেশের প্রায় সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকি করছে। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, জনবলের তীব্র সংকট থাকার পরও জঙ্গিবাদ দমনে র‌্যাব সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের সর্বোচ্চটা উজাড় করেই প্রতিটি র‌্যাব সদস্য কাজ করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর