বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভাগ্নে মাহফুজের শরীরজুড়ে নখের আঁচড়

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

ভাগ্নে মাহফুজের শরীরজুড়ে নখের আঁচড়

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত পাঁচ খুনের ঘটনায় রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। পাওয়া যাচ্ছে রোমহর্ষক তথ্য। নিহত তাসলিমার ননাস আছিয়ার ছেলে মাহফুজের শরীরে পাওয়া গেছে অসংখ্য নখের আঁচড়। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন, ওই ঘটনার সঙ্গে মাহফুজ কোনো না কোনোভাবে জড়িত। তবে মাহফুজের মুখ থেকেই সব শোনার অপেক্ষায় রয়েছে তদন্ত সংস্থা। আজকের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন। তবে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খোলেননি মাহফুজ। স্বীকার করেননি হত্যায় জড়িত থাকার কথা। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে এ তথ্য। এদিকে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ যে ২৬ ধরনের আলামত সংগ্রহ করেছে এর মধ্যে চুলও রয়েছে। ওই চুল খুনিদের কারও হতে পারে বলে ধারণা তদন্ত কর্মকর্তাদের। ফরেনসিক বিভাগ ও ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর অনেক বিষয় পরিষ্কার হবে বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

সোমবার পাঁচ খুনের ঘটনায় মামলার বাদী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। এর এক দিন পর শরীয়তপুরের ডামুড্যা থেকে গ্রেফতারের এজাহারনামীয় আসামি নাজমা বেগমকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে নাজমা নিহত তাসলিমার কাছ থেকে টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও হত্যার ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। নাজমা প্রেসার ও ডায়াবেটিস রোগী বলে তাকে অনেকটা নিরাপদেই রেখেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, রিমান্ডে মাহফুজ মুখ না খুললেও শরীরে অসংখ্য নখের আঁচড় দেখে হত্যায় কোনো না কোনোভাবে তার সম্পৃক্ততা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। ঘটনার সময় নিহতরা বাঁচার জন্য মাহফুজকে আঁকড়ে ধরতে পারে। এ কারণেই মাহফুজের শরীরের বিভিন্ন স্থানে নখের আঁচড় বলে তারা মনে করছেন। মাহফুজ জড়িত থাকলে ওই সময় আর কে কে এই কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল তা জানার চেষ্টা চলছে। এ জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, প্রমাণাদি সংগ্রহ করছে ডিবি পুলিশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাদী শফিকুল ইসলামের বড় বোন আছিয়া বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মাহফুজ বড়। দুই সন্তান ও স্বামী শরফুল মিয়াকে নিয়ে আছিয়া বেগম শহরের পাইকপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। মাহফুজের বাবা শরফুল মিয়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা। শফিক-তাসলিমা দম্পতি যখন রাজধানীর কলাবাগানে বসবাস করত, তখন মাহফুজও সেখানকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিয়নের কাজ করতেন। দুই বছর আগে শফিকুলের ভাই শরিফ বিয়ে করেন লামিয়াকে। শরিফ ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এদিকে লামিয়াকে বিয়ের পর তার ওপর কুনজর পড়ে ভাগ্নে মাহফুজের। ঢাকার কলাবাগানে থাকাকালে একদিন ফাঁকা ঘরে লামিয়াকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান মাহফুজ। ঘটনাটি জেনে মাহফুজকে জুতাপেটা করে ঘর থেকে বের করে দেন তাসলিমা। লামিয়া ঘটনাটি শফিকুলকেও জানিয়েছিলেন বলে এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন তিনি। তখন মাহফুজকে শফিকুল বকাঝকা করে বাসায় যেতে নিষেধ করেন। শফিক বলেন, ৯ মাস আগে ঋণদাতাদের চাপে তাসলিমা নারায়ণগঞ্জে এসে বসবাস শুরু করলে তার সঙ্গে লামিয়াও চলে আসেন। ওই সময় মাহফুজও ঢাকার চাকরি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসে। শফিকের শ্যালক ও নিহত তাসলিমার ছোট ভাই মোর্শেদুল ছোটবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জে বড় হয়েছেন খালা রমিজা ওরফে রুমিয়া বেগমের কাছে। কয়েক বছর আগে তিনি হোসিয়ারির কারখানা দেন। তিন মাস আগে হোসিয়ারির কলেবর বড় করেন মোর্শেদুল। তার কারখানায় ১৪টি মেশিন রয়েছে। তাসলিমা নারায়ণগঞ্জে চলে আসার পর থেকে তার বাসায়ই থাকতেন নিহত মোর্শেদুল। শফিকুল বলেন, স্ত্রী তাসলিমার ঋণের বিষয়টি তিনি দুই বছর আগে জানতে পারেন। তবে ঋণ নিয়ে টাকা কী করেছেন তা বারবার জিজ্ঞেস করেও জানতে পারেননি তিনি ও তার শাশুড়ি। তিনি বলেন, ছোট ভাই মোর্শেদুলের সুবিধার্থে তাসলিমা তিন মাস আগে শহরের বাবুরাইলে এসে বাসা নেন। এক মাস আগে ভাগ্নে মাহফুজকে মোর্শেদুল তার কারখানায় কাজে নেন। তখন শফিকুল ও তার ছোট ভাই শরিফ অতীতের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মাহফুজকে যাতে মোর্শেদুল কাজে না নেন এ বিষয়ে বারণ করেন। কিন্তু আত্মীয়তার সুবাদে মাহফুজকে মোর্শেদুল নিজ কারখানায় কাজ দেন। স্ত্রীর ঋণ সম্পর্কে শফিকুল বলেন, ‘তাসলিমা নারায়ণগঞ্জে চলে আসার পর পাওনাদাররা আমাকে এসে ধরত। আমি তাদের বলেছি, আপনাদের টাকা আস্তে আস্তে শোধ করে দেব। আমার স্ত্রীকে আপনারা কিছু বোলেন না।’ তার এ কথায় কোনো কোনো পাওনাদার আশ্বস্ত হন বলেও তিনি জানান। তবে নারায়ণগঞ্জে চলে আসার পর কোনো পাওনাদার এ পর্যন্ত আসেননি বলেও তিনি জানান। শফিকুল বলেন, ঘটনার দিন বিকালে ছোট ভাই শরিফ মামার বাড়ি কিশোরগঞ্জ থেকে মা আমেনা বেগমকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফেরেন। ১৪ ডিসেম্বর নানির চল্লিশায় অংশ নিতে মামার বাড়ি যান শরিফ। ফেরার সময় মাকে নিয়ে ফেরেন।

তাসলিমার মা মোর্শেদা বেগম বলেন, তিনি রাজধানীর ধানমন্ডি ৭ নম্বরে মাসে ছয় হাজার টাকা বেতনে এক ব্যবসায়ীর দুই সন্তানকে ১৫ বছর দেখাশোনা করেছেন। ওই বাড়িতেই তিনি বসবাস করতেন। বেতনের পুরো টাকাই তিনি তাসলিমাকে দিয়ে দিতেন। তাসলিমা এত টাকা ঋণ করেছেন শুনে গ্রামের বাড়ি থেকে ৩০ শতাংশ জমি তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ছেলে মোর্শেদুলকে দিয়েছেন এবং ২০ হাজার টাকায় নিজের ঋণ মিটিয়েছেন। একটিমাত্র ঘটনায় তিনি তার দুই সন্তানকেই হারিয়ে একা হয়ে গেছেন। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, ১৫-২০ দিন আগে তাসলিমা তাকে ফোন করে বলেছিলেন, মা, তুমি একটু সাবধানে থেকো। কারণ জানতে চাইলে তাসলিমা বলেছিলেন, যারা তার কাছ থেকে টাকা পায়, তারা তাকে ফোনে হুমকি দিয়ে বলেছে, আমাকে না পেলে তারা নাকি তোমাকে ধরবে। শফিকুল অভিযোগ করে জানান, নিহত লামিয়ার স্বামী তার ভাই শরিফকে পুলিশ আটক রেখেছে। সদর থানায় গভীর রাতে শরিফকে তিনি ভেজা শরীরে দেখতে পেয়েছেন। শরিফ শীতে কাঁপছিলেন। শফিকুলের সন্দেহ, শরিফকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে। এদিকে গতকাল সকালে শহরের খানপুরে ডিবি অফিসে বাদী মো. শফিকুল, তার খালাতো ভাই দেলওয়ার, ভাতিজা শাহাজাদা, নিহত তাসলিমার মা মোর্শেদা বেগম, নিহত মোর্শেদের হোসিয়ারি শ্রমিক কাটিংম্যান সাইফুল, অপারেটর নাজমুল ও নয়নকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত সংস্থা নারায়ণগঞ্জ ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশীদ মণ্ডল জানান, খুনের ঘটনায় সাক্ষ্য গ্রহণে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে কাকে কাকে এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাদের নাম প্রকাশ করেননি তিনি। মামলার অগ্রগতির প্রশ্নে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘মামলায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এখন ছোট ছোট বিষয় মেলানো হচ্ছে। আগামীকালের মধ্যে (আজ) এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।’ প্রসঙ্গত, শনিবার শহরের ২ নম্বর বাবুরাইলের ১৩২/১১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ছয়তলা বাড়ির নিচতলা থেকে দুই শিশুসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন— তাসলিমা বেগম (৩৫), তার ছেলে শান্ত (১০), মেয়ে সুমাইয়া (৫), ছোট ভাই মোশারফ ওরফে মোর্শেদুল (২৫) এবং জা লামিয়া বেগম (২৫)।

শোকে বিহ্বল শফিকুল : স্ত্রী তাসলিমা এবং দুই শিশুসন্তান শান্ত (১০) ও সুমাইয়াকে (৫) হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন পাঁচ খুন মামলার বাদী মো. শফিকুল। গতকাল ডিবি কার্যালয়ের বাইরে দুই শিশুর কথা স্মরণ করে তার চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, ‘প্রতি বৃহস্পতিবার আমি ছুটিতে আসতাম। আমার শান্ত ও সুমাইয়া ফল খুব পছন্দ করত। শুক্রবার শেষ কথা হয় শান্ত ও সুমাইয়ার সঙ্গে। গেল বৃহস্পতিবার ছুটি পাইনি বলে জানিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘খুনি যারাই হোক তাদের শাস্তি হলে শান্তি পাব।’

সর্বশেষ খবর