শনিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

হতবাক স্বজনরা, মাহফুজের বক্তব্য নিয়ে সংশয়

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

হতবাক স্বজনরা, মাহফুজের বক্তব্য নিয়ে সংশয়

পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে বিমর্ষ-বাকরুদ্ধ মামলার বাদী শফিকুল গতকাল সারা দিন দুই সন্তানের সঙ্গে তোলা তার শেষ সেলফি দেখছিলেন আর কাঁদছিলেন। অন্যদিকে নিহত মোর্শেদুলের একটি ভুলেই মাহফুজ এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলে স্বজনরা অনুশোচনায় ভুগছেন। তা হলো, গভীর রাতে খাটের নিচে ধরা পড়ার পর মোর্শেদুল সমবেদনা দেখিয়ে মাহফুজকে নিজ কক্ষের খাটে ঘুমানোর সুযোগ করে দেন। এদিকে মাহফুজের বক্তব্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়।

গতকাল সন্ধ্যায় শফিকুলের মুঠোফোনে কল দিলে রিসিভ করেন নিহত স্ত্রী তাসলিমার মা মোর্শেদা বেগম।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার পোলা মোর্শেদুল অত্যন্ত সরল ছিল। শনিবার ঘটনার দুই দিন আগে বৃহস্পতিবার মাহফুজকে এক হাজার টাকা দিয়েছিল মোর্শেদুল। বলছিলাম, ওরে তোর সঙ্গে রাখিস না। মোর্শেদুল কইল, মাগো, পোলাডারে সুযোগ দ্যাও, নইলে ভালো হইব ক্যামনে।’

মোর্শেদা বেগম বলেন, ‘খুনি মাহফুজের বিচার চাই। তার পিঠের চামড়া তুলে লবণ দিলেও সাধ মিটব না।’ ক্ষোভের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মাহফুজের পরিবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তারা সব রকম আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে মোর্শেদুলের কারখানার শ্রমিক নাজমুল, দেলু ও সাইফুল গতকাল কারখানা খুলে সারা দিন কেঁদেছেন। শ্রমিক নাজমুল বলেন, ‘আমি দেশের বাড়িতে গেলে আমাদের মালিক মোর্শেদুল নিজে গিয়া আমাকে গাড়িতে তুইল্লা দিত। স্যারেরে এইভাবে কেউ মারব চিন্তাও করতে পারি নাই।’

এদিকে স্ত্রী তাসলিমা, ছেলে শান্ত ও মেয়ে সুমাইয়াকে হারিয়ে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন শফিকুল। এতে দুর্বল হয়ে পড়েছে তার শরীর। দুর্বল শরীর নিয়ে শফিকুল বিছানায় পড়ে থাকছেন। সারাক্ষণ শুধু বলছেন, ‘আমার শান্ত, সুমাইয়া আর বলব না, আব্বা, আমাগো লাইগা ফল নিয়ে আইসো। আমার সব শেষ!’ শফিকুল জানান, ঢাকায় চাকরির কারণে তিনি সপ্তাহে এক দিন বাড়িতে আসতেন। স্বজনরা জানান, অসুস্থ শফিকুল মুঠোফোনে সেভ থাকা দুই সন্তানের সঙ্গে তার শেষ সেলফি দেখছেন আর কাঁদছেন। সম্প্রতি শফিকুল একটি নতুন মুঠোফোন কেনেন। নতুন ফোন দিয়ে ছেলে শান্ত ও মেয়ে সুমাইয়া বাবা শফিকুলকে সেলফি তুলতে বলে। একই ফ্রেমে পিতা-পুত্র-কন্যা বন্দী হলেও তাসলিমা ছিলেন না সেই সেলফিতে। কারণ তাসলিমার ছবি তোলার আগ্রহ খুব একটা ছিল না। ওই ছবিটিই (সেলফি) তাদের তোলা সর্বশেষ ছবি। সেই সেলফি দেখেই এখন দিন কাটছে শফিকুলের।

এদিকে খুনি ভাগ্নে মাহফুজ জীবনে এবারই প্রথম পাঁচজন মানুষকে হত্যা করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের কাছে নারায়ণগঞ্জে একই পরিবারের পাঁচজন খুনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় খুনি মাহফুজ অকপটে সব স্বীকার করে। খুনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহফুজ পুলিশের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তাকে বলে ওঠে, ‘আরে চুপ করেন না, আগে বুঝেন, হের পর প্রশ্ন করেন।’ শিলপাটার পুতা দিয়ে মোর্শেদুলকে আঘাত করার সময় মাহফুজকে তদন্ত কর্মকর্তা ‘পুতা কোথা থেকে এনেছ’ জিজ্ঞেস করলে সে বলে ওঠে, ‘আগে বুঝেন পরে কথা কন।’ এভাবে মাহফুজ নিজেই তদন্ত কর্মকর্তাদের চুপ করিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা পরস্পর ইংরেজিতে বাদানুবাদ করার সময় মাহফুজ বলে ওঠে, ‘এহন তো আমার ভয় করতাছে, আপনারা কী কওয়াকওয়ি করতাছেন স্যার। হায় হায় স্যার, এখন তো আমার ভয় করতাছে।’ এই বলে সে মুষড়ে পড়ে। এ সময় পুলিশের এক কর্মকর্তা হেসে বলে ওঠেন, ‘আরে, আমরা কি কথা বলব না!’

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার ভাগ্নে মাহফুজ পাঁচ খুনের দায় স্বীকার করে জানায়, মামি লামিয়ার ওপর ক্ষোভ থেকে সে একাই পাঁচজনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তার হত্যার বর্ণনা ফিল্মের ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। খোদ তদন্ত সংস্থার কর্তারাও ধারণা করতে পারেনি যে একাই পাঁচজনকে হত্যা করতে পারে মাহফুজ।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ জানান, এ হত্যাকাণ্ড থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে, অপরাধ যত ছোট হোক, অপরাধীকে সুযোগ দিতে নেই। কারণ অপরাধীরা সুযোগ পেলে অপকর্ম করবেই। রাতে মাহফুজকে খাটের নিচ থেকে ধরে ফেলার পরও মোর্শেদুল সমবেদনা দেখিয়ে তার সঙ্গেই ঘুমাতে দেয়। এ সুযোগটিই গ্রহণ করে মাহফুজ। প্রসঙ্গত, শনিবার রাতে ২ নম্বর বাবুরাইল এলাকার প্রবাসী ইসমাইল হোসেনের ১৩১/১১ নম্বর বাড়িতে একই পরিবারের পাঁচজন খুন হয়।

সর্বশেষ খবর