সোমবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
অন্য চোখ

লাল সোয়েটার

সামিয়া রহমান

লাল সোয়েটার

তীব্র শীত। গায়ে সোয়েটার। ঘন কুয়াশায় হনহন করে হেঁটে যাচ্ছি আমরা। হাড় কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আজিমপুরের পুকুর থেকে কুয়াশামাখা ধোঁয়াচ্ছন্ন অদ্ভুত এক অবাক দৃশ্য। যদিও প্রবল শীতের আলসেমিতে সে দৃশ্য দেখার মন তখন ছিল না। রোদ মাখানো ওম ওম সকালের তখনো ঢের বাকি। শীতে আমরা সবাই কাতর। আমি আর আমার বোনেরা। পরনে ছিল লাল সোয়েটার। লেপ ছেড়ে মন কোনোভাবেই চাইত না স্কুলের জন্য তৈরি হতে।

মুখ খুললেই ধোঁয়া বের হওয়া এক অবাক সকাল। তার মধ্য দিয়ে হেঁটে  যেতাম আমরা। সেই অগ্রণী স্কুল। সেই পুকুর পাড়। সেই ছোট্ট পথটুকু। সারি সারি মেয়েদের কলকাকলিতে মুখরিত। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা শিশির বিন্দুকে অগ্রাহ্য করে আমরা এগিয়ে যেতাম। শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দ হারিয়ে যেত আমাদের উচ্ছ্বাসে। শহুরে ইট সিমেন্টের পরিবেশেও হিমেল বাতাসে ভেসে আসা ভাপা পিঠার মিষ্টি গন্ধ আমাদের প্রবলভাবে টানত। শীত এলেই খুব ছোটবেলার এই দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে। জানি না বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিবর্তনে সেই ছোটবেলার নভেম্বরের শীত এখন জানুয়ারির শেষে এসে জানান দেয় কিনা, কিন্তু নতুন বই এর গন্ধ, নতুন ক্লাস, নতুন বন্ধু সব মিলিয়ে দারুণ এক অস্থির উত্তেজনার মধ্যে সময় কাটত আমাদের। একবার এক হাড় কাঁপানো শীতে স্কুলে এক নোটিস এলো। এখন থেকে স্কুলে লাল সোয়েটার পরা বাধ্যতামূলক। শুধু স্কুল ইউনিফর্ম পরলেই চলবে না, সোয়েটারের রংও সবার এক হতে হবে। লাল সোয়েটার পরতে হবে, নতুবা নয়। একটি নতুন লাল সোয়েটারের উত্তেজনায় আমরা উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত। কিন্তু ছোট্ট মস্তিষ্কে ছিল না খেয়াল, বছর শুরুতে নতুন বইয়ের সঙ্গে স্কুল ভর্তির বেতনের টাকা শোধ করে নতুন সোয়েটার বাবা-মায়ের জন্য কতটা পীড়াদায়ক হতে পারে। পীড়া বোঝার ক্ষমতা ছিল না বলেই প্রতিদিন মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম সোয়েটারের জন্য। মাথায় ছিল ইউনিফর্ম না পরার শাস্তির ভয়। চার বোনের চারটি লাল সোয়েটার সারা রাত জেগে হাতে বুনে মা তৈরি করে দিয়েছিলেন। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেওয়া আমার সন্তানেরা কি এখন টের পায় আমার বাবা-মায়ের সেই অসহায় কষ্টটুকু? পুরো স্কুল জীবনটা পার করেছিলাম সেই একটি লাল সোয়েটার দিয়ে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরটি গায়ে না হলে সেটি ছোট বোনকে দিয়ে দিতাম, বড় বোনদের সোয়েটার আমি পরতাম। এভাবেই আমরা পার করেছিলাম আমাদের শৈশব। কলেজ জীবনে এসে আমি প্রথম লাল সোয়েটারের বাইরে কিছু পরার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার ডাক্তার নানা বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলেন চমৎকার এক বাহারি সোয়েটার। বন্ধুদের হাল ফ্যাশনের সোয়েটার দেখাতে পারব এই চিন্তাতেই ছিলাম আনন্দিত। একটিই সোয়েটার, কিন্তু তাই ছিল যথেষ্ট। দিন সাতেক পরে সোয়েটারটি নোংরা হয়ে যাওয়ায় মা সেটি ধুয়ে দেন। কিন্তু পরদিন ক্লাস। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। ভেজা সোয়েটার আর শুকোয় না। কী করি, আমি কী করি! নিজের উর্বর বুদ্ধি দিয়ে ভেজা সোয়েটার ইস্ত্রি করে শুকানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। ফলাফল, উলের সোয়েটারটি হয়ে গেল পাতলা সুতি কাপড়ের মতো ফ্যালফ্যালে। ছিল না আর কোনো শীতের পোশাক, স্কুলের সেই লাল সোয়েটারটি ছাড়া। রাগে-দুঃখে সেবার পুরো শীত পার করেছিলাম সোয়েটার ছাড়াই। টের পেয়েছিলাম শীত কাকে বলে, কত নির্মম তার আচরণ। আমাদের শহুরে জীবনে কলকারখানা, গ্যাস, ঘনবসতি, মানুষ উপচানো রাস্তার কারণে আমরা বুঝতেই পারি না হাড় কাঁপানো শীতের কী যন্ত্রণা। কিন্তু ফুটপাথ, বস্তি, বাস-ট্রেন স্টেশন, খোলা রাস্তাঘাটে যেসব মানুষ ঘুমায় তাদের ঠকঠকে শীতের কাঁপুনি কি আমরা টের পাই? দূর থেকে ছেঁড়া কাগজ জ্বেলে আগুন পোহানো দেখি, কাছে গিয়ে কি শীতের শরীর চোষা ঠাণ্ডাকে অনুভব করতে পারি? আমরা শহুরে মানুষরা প্রতিবার শীত এলেই প্রতিযোগিতায় নেমে যাই নতুন নতুন শীতের পোশাকের উৎসবে। কিন্তু যাদের এক টুকরো শীতের কাপড় বা মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, পায়ে নেই জুতো, তাদের জীবনেও শীত কি আনন্দের বা উৎসবের বার্তা আনতে পারে? শীতের কষ্ট কী, আমি বা আমরা আসলেই জানি? আর কিছু পারি আর নাই পারি, আমরা তো পারি অন্তত একজন মানুষকে ওম দিতে। হাত পেতে শীতের কাপড়ের উষ্ণতার জন্য ভিক্ষা চাইতে আসা শিশু বা বৃদ্ধটিকে রূঢ়ভাবে মাফ করতে বলার আগে কি একটু ভাবি, আমার সামান্য সাহায্য তাকে একটু বেঁচে থাকার সুযোগ দেবে। কোথায় যেন দেখে ছিলাম লেখা, ‘এ শহরে আলো-আঁধারে প্রেম আসে, কিন্তু আসে না আর ডাকাত পড়া শীত’। যদিবা আসে, আসে না আমাদের একে অন্যের প্রতি মমতা, উষ্ণতা আর ভালোবাসার গীত। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর