বুধবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ধরাছোঁয়ার বাইরে ওরা

সোনা চোরাচালান মামলা তদন্তের আগেই জামিন, জড়িত বিমানকর্তারাও

সাইদুর রহমান রিমন ও জিন্নাতুন নূর

ধরাছোঁয়ার বাইরে ওরা

চোরাচালানের চার পদ্ধতি ১. জুতার ভিতরে ২. পেন্টের ভিতরে ৩. গলার বিশাল চেইন ৪. মোবাইল ফোনের ব্যাটারিতে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

অব্যাহত অভিযান সত্ত্বেও সোনা চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। সোনা চোরাকারবারিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির তোয়াক্কা করছে না। তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সোনা পাচারের অংশ হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছে অভিনব ও অদ্ভুত সব পাচার কৌশল। এ কৌশলের অনেকগুলোই গা শিউরে ওঠার মতো। 

এমনকি সোনা চোরাচালান নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে পাচারকারিরা। এসব নিত্যনতুন কৌশলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তথা সোনার  চালান ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের বেশ কয়েক দিনের অনুসন্ধানে সোনা পাচারের আবিষ্কৃত-অনাবিষ্কৃত নানা কৌশল বেরিয়ে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো বটেই এমনকি সাধারণদেরও চোরাচালানিদের এসব অভিনব কৌশল অবাক করে দেয়। অথচ ঢাকা কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে সন্দেহজনক হলে টু-ডি ডাইমেনশন পদ্ধতির মাধ্যমে যাত্রীদের লাগেজ ও দেহ তল্লাশি করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে সব সময়ই যে তারা সফল হন তা নয়। তবে উন্নত বিশ্বে ‘বডি এক্সরে’ ও ‘থ্রিডি’ মেশিনের সাহায্যে যাত্রীর দেহ তল্লাশি করা হয়। তাতেই যাত্রী তার সঙ্গে সোনা বহন করছেন কিনা তা সহজেই ধরা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এই মেশিনগুলো কেনার জন্য ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব দিলেও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে তারা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, আপাতত দুটি থ্রিডি মেশিন কনভেয়ার বেল্টে লাগানো গেলেই সোনা পাচার অনেক কমে আসবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিনব কায়দায় কখনো চায়ের ফ্লাস্ক, বিদেশি বিস্কুটের প্যাকেট, জুসের প্যাকেট, জুতার ভিতর, প্যান্টের বেল্টের ভিতর, নারীর চুলের খোঁপায়, দেহের গোপনীয় জায়গায়, ল্যাপটপ এমনকি ওয়াটার পাম্পের ভিতরে করে সোনার বার পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া কিছু সোনার বার দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়লেও সীমান্তপথে বড় অংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে যায়। লাগেজ কেটে বিশেষ পার্ট বানিয়ে, জুতার ভিতরে কিংবা পায়ুপথে সোনার বার ঢুকিয়ে পাচার করার পুরনো কাহিনী এখন আর পাত্তা পায় না। এয়ারপোর্টে কাস্টমস গেটের স্ক্যানার মেশিনেও যেমন সোনার অবস্থান চিহ্নিত হয় তেমনি পাচারকারীর চলাফেরার সন্দেহেও সোনা পাচারকারীরা মুহূর্তেই ধরা পড়ে। ফলে চোরাচালানকারী ইদানীং এমন সব কৌশল ব্যবহার করছেন যা ধারণা করাও কঠিন। বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গরুর পেটের ভিতর সোনার বার ঢুকিয়েও ভারতে পাচারের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি শিলিগুড়ি পানির ট্যাংকির কাছে নয়াবস্তিতে ৯৩টি গরু উদ্ধার করে ভারতীয় এএসবি। উদ্ধার হওয়া ৯৩টি গরুর মধ্যে একটি গরুর সিংয়ে লাল রং ও পেটে সেলাইয়ের দাগ ছিল। সন্দেহ হওয়ায় বোম স্কোয়াড দিয়ে পরীক্ষা করে জানা যায়, গরুর পেটে বিস্ফোরক নেই। তবে মেটাল ডিটেক্টরে গরুটির পেটের ভিতর সোনার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। সোনা চোরাচালানের আরেকটি নতুন পদ্ধতির নাম খাতা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সাধারণত ২ ফুট বাই ১ ফুট এর একটি কালো বা মেরুন মার্কিন কাপড়ের উপরে ১২০ থেকে ১৫০টি সোনার বার রাখা হয়। যার প্রতিটি ১০ তোলা অথবা ১০০ গ্রাম। কাপড়ের দৈর্ঘ্য বরাবর লম্বালম্বি রেখে আরেকটি সমান মাপের এবং সমরংয়ের কাপড়ের উপর মিলিয়ে রেখে প্রতিটা বারের ফাঁকে ফাঁকে সেলাই করে একখানা মোটা পাপোশের আকার দেওয়া হয়। যাকে বলা হয় খাতার এক ইউনিট। এভাবে দুটি করে সর্বোচ্চ ১৫ খানা খাতা একসঙ্গে আনার ঘটনা উদ্ঘাটন হয়েছে বিমানবন্দরে। আর এভাবে প্রতি খাতায় ৮ থেকে ১৫ কেজির মতো সোনা আনার ঘটনা ঘটেছে। যার বাজার মূল্য চার কোটি থেকে সাড়ে সাত কোটি টাকা। এই সোনা সাধারণত উড়োজাহাজের কার্গো হোল, প্যানেল বক্স, ওয়াশরুমসহ বিভিন্ন গোপন জায়গায় রাখা হয়। এ ছাড়া সোনা চোরাচালানে বিদেশি নারীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ৬ কেজি সোনাসহ মালয়েশিয়ার এক নারীকে আটক করা হয়। আর্মড পুলিশ জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে চোরাকারবারি বিদেশি নাগরিক ভাড়া করে সোনা পাচারের কৌশল নিয়েছে। আরও অন্যান্য কৌশলের অংশ হিসেবে জুসের প্যাকেট থেকে সোনার বার উদ্ধার করেছে বিমানবন্দর শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরা নারায়ণগঞ্জ সদরের আলামিন (২৩) নামের এক যাত্রীর ট্রাভেল ব্যাগ থেকে বারগুলো উদ্ধার করা হয়। আলামিনের স্কুল ব্যাগের ভিতরে ইয়োস নামের এক জুসের প্যাকেট ছিল। তল্লাশির সময় জুসের প্যাকেট হাতে নেওয়া হলে অনেক বেশি ওজন দেখে সন্দেহ হয়। পরে সেটি খুলে দেখা যায়, আসলে সেখানে কোনো জুস নেই, আছে সোনার বার। এর আগে শারজা থেকে আসা পানির পাম্পের ভিতরে করে নিয়ে আসা ৪ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের সোনার বার উদ্ধার করা হয়। শুল্ক, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছর আমরা ৬০০ কেজির তথা ১৩ মণ সোনা উদ্ধার করেছি। তবে আমাদের দক্ষ জনবলের কারণে আগের চেয়ে সোনা চোরাচালানের ঘটনা কমে এসেছে। চোরাচালান প্রতিরোধে আমরা নতুন রুট সন্ধান করছি। এ জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করছি। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করছি। বিশেষ করে ডগ স্কোয়াড ব্যবহার, ঢাকা কাস্টমসে পোর্ট কন্ট্রোল ব্যবহার ইত্যাদি শুরুর জন্য পরিকল্পনা করছি। আমরা এখন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের জনবলের মানসিক পরিবর্তন আনার কাজ করছি।  সম্প্রতি গার্মেন্ট এক্সেসরিজের আড়ালেও সোনার চালান দেশে আনার কৌশল ধরা পড়েছে। বিভিন্ন গার্মেন্ট এক্সেসরিজের নমুনা বোঝাই তিনটি কার্টনে আনা ৪৩ কেজি সোনা আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। আটককৃত সোনার বাজার মূল্য প্রায় ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার উম্মে নাহিদা আক্তারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি ভুয়া গার্মেন্ট কারখানার ঠিকানায় এক্সেসরিজ আনার ঘোষণা দিয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসে কার্টনগুলো। সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে বহনকারীরা জীবনের ঝুঁকি নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক যাত্রীর পাকস্থলি থেকে সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। কাজী রফিকুল ইসলাম (৩৬) নামে এক যাত্রী কাস্টমস কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভিনব কৌশলে নিয়ে আসা ৬টি সোনার বারসহ বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ফিল্মি কায়দায় তিনি পেটের মধ্যে দুটি সিনথেটিক প্যাকেটে সোনার বার বহন করছিলেন। কিন্তু তার সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে কাস্টমস ও শুল্ক বিভাগের কর্মীরা তাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং উত্তরার একটি ক্লিনিকে নিয়ে এক্স-রে করানোর পর তার পেটের ভিতর সোনার অস্তিত্ব মেলে। এ সময় চিকিৎসকরা তাকে গ্লিসারিন সাপোজিটর ব্যবহার করানোর মাধ্যমে সিনথেটিক প্যাকেট বের করে আনেন। দুটি প্যাকেটে ৭০০ গ্রাম ওজনের ছয়টি সোনার বার পাওয়া যায়।

সোনা চোরাচালান মামলার তদন্তের আগেই জামিন : রাজধানীর বিমানবন্দর থানার একটি সোনা চোরাচালানের তদন্তের আগেই ওই মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামিকে জামিন দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ মাতবর (২৭) নামের ওই আসামিকে গতকাল জামিনের আদেশ দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. কামরুল হোসেন মোল্লা। গত ১২ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ মাতবর ও অন্য একজনের দেহ তল্লাশি করে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আনা ৫২২ গ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এজাহারে তাদের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। আইনজীবীরা জানান, সোনা চোরাচালান মামলায় সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্টও জামিন দিতে তেমন একটা আগ্রহী হন না। সেখানে মামলা তদন্তের আগেই দেড় মাসের মধ্যে এ আসামিকে জামিন দেওয়ায় আদালতপাড়ায় গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে।

সন্দেহের তীর বিমান কর্মকর্তাদের দিকে : হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বিমান থেকে প্রায় ৩৩ কেজি সোনা উদ্ধারের ঘটনায় জড়িত কেউ ধরা পড়েনি। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যার পর ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মেওয়াজ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। ঢাকা কাস্টমস হাউস সূত্র বলছে, সোনাগুলো পাচারে ওই বিমানের কোনো কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। সোমবার রাত সোয়া ১১টার দিকে মালয়েশিয়া থেকে আসা মালিন্দ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট (ওডি-১৬২) থেকে ৩২ কেজি ৭০০ গ্রাম সোনা জব্দ করা হয়। সোনাগুলো ওই বিমানের সিট কভারের নিচে লুকানো ছিল। সূত্র জানায়, বিমানের কোনো কর্মকর্তা বা সিভিল অ্যাভিয়েশনের কেউ জড়িত থাকতে পারেন। এ ছাড়াও বিমানের যে সিট কভারের নিচে সোনাগুলো রাখা ছিল সেই সিটের যাত্রীকে আটক করলেই সব জানা যাবে। তাকেও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার শহিদুজ্জামান সরকার জানান, সোনাগুলো বড় কোনো আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে পাচারের উদ্দেশে ঢাকায় আনা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বিমানের কোনো কর্মকর্তা বা সিভিল অ্যাভিয়েশনের কেউ জড়িত থাকতে পারেন। এ বিষয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়েছে। বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর