শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফুয়েল না দিলে ফাইল নড়ে না

সাঈদুর রহমান রিমন

ফুয়েল না দিলে ফাইল নড়ে না

রীতিমতো ফাইল ঠেকিয়েই আদায় হচ্ছে অর্থ। ফুয়েল না দিলে নড়ছে না ফাইল। নাগরিক অধিকার হিসেবে রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা পেতেও আগে ঘুষ দিতে হচ্ছে। ঘুষের টাকা না দিলে প্রাপ্য সেবাটুকুও ভাগ্যে জুটছে না। মোদ্দা কথা, নাগরিক সেবাও টাকা দিয়ে কিনে নিতে হচ্ছে। এমনকি সরকারি ত্রাণের ভিজিএফ কার্ড আর দান-খয়রাতের গম পেতেও দায়িত্ববানদের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। অন্যথায় দুস্থজনের তালিকায় নামটাও লিপিবদ্ধ হবে না। সরকারের উচ্চমহল থেকে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই অবৈধ লেনদেন ‘প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ পেয়ে বসেছে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, ঘুষ কোথায় আছে সে প্রশ্ন নয়, বলুন কোথায় নেই? সর্বত্রই ঘুষের দৌরাত্ম্য। অর্থ ছাড় পেতে এক মন্ত্রণালয় ঘুষ দিয়েছে অন্য মন্ত্রণালয়কে— এমন নজিরও আছে দেশে। সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন তুলতেও আরেক সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হয়। গ্যাস, বিদ্যুত্, ওয়াসার পানি থেকে শুরু করে নাগরিক সেবার অন্তত ৩৭টি খাতের ন্যূনতম সেবাও চাহিদামাফিক টাকা দিয়েই কিনে নিতে হচ্ছে। প্রশাসন, কাস্টমস, পুলিশ, সার্ভিস খাতে ঘুষ লেনদেন ওপেন সিক্রেট।

ঘুষের অস্তিত্ব নেই এমন ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন কাজ। ঘুষ ছাড়া কোথাও কোনো কাজই এখন হয় না। ফুয়েল না দিলে ফাইল নড়ে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ঘুষ না দিলে চাকরি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশও কার্যকর হয় না। বছর যায় পরিস্থিতি বদলায় না, বরং ঘুষ-দুর্নীতির নতুন নতুন খাত সৃষ্টি হয়েছে— পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লুটপাটও। দুর্নীতির আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশ এ বছরও ১৩তম স্থান দখল করে আছে। সরকারের প্রশাসনে, দফতর-অধিদফতরের সর্বত্রই চলছে অবৈধ লেনদেন। ঘুষ ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না। কাগজপত্র যতই সঠিক থাকুক, দাবি যতই ন্যায্য হোক— টাকা ছাড়া কাজ হবে না। এমনকি আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেও টাকার দাবি পূরণ করতে হচ্ছে। বৈধ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে, পুলিশি সাহায্য নিতে এমনকি চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের অভিযোগ জানাতে হলেও চাহিদামাফিক টাকা দিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি নিতেও টাকা লাগছে। নিজের অভিযোগ শুনিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা আরও পরের ব্যাপার।

টাকা দিয়ে কথা বল, চাহিদা পূরণ করে প্রতিকার পাও— এমন পরিস্থিতি চলছে মন্ত্রণালয়, অধিদফতর থেকে গ্রামীণ পর্যায়ে বিস্তৃত সরকারি কাঠামোর সব ইউনিটে। চাহিদামাফিক টাকার বিনিময়ে ‘দয়া’ বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেপরোয়া পরিস্থিতি চলছে পুলিশ বিভাগে, গ্যাস-বিদ্যুত্ খাতে, কাস্টমস, রাজউক, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, এলজিইডি, বিআরটিএ, শিক্ষা, ভূমি, স্বাস্থ্য সেক্টরের ধাপে ধাপে। ঘুষবাণিজ্য রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা পাওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। পুলিশ শুধু ভুক্তভোগী, বিচারপ্রার্থী বা নিরীহ পথচারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েই আয়েশ করতে পারছে না, তারাও পদস্থ কর্মকর্তাদের কব্জা থেকে বিন্দুমাত্র ছাড় পাচ্ছে না। পুলিশে নিয়োগ, বদলি, পোস্টিং, পদোন্নতি এমনকি ছুটিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নিজেরাও মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদানে বাধ্য হচ্ছে। অনেক দফতরে মাসিক হারেও ঘুষ প্রদানের নজির আছে। আদালতের ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিরা থানায় থানায় মাসিক হারে টাকা দিয়ে তবেই গ্রেফতারমুক্ত থাকতে সক্ষম হন। অপরাধ-অপকর্ম, মাদকবাজার, নারীবাণিজ্য, জুয়াবাণিজ্য বহাল রাখতেও ঘাটে ঘাটে মাসিক এমনকি সাপ্তাহিক হারেও ঘুষ ধার্য করা আছে। স্বাস্থ্য সেক্টরের তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত টাকা লেনদেনে রাখঢাকেরও বালাই নেই। স্বাস্থ্য শিক্ষা তথা মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীদের ভর্তি থেকে শুরু করে হাসপাতালে রোগী ভর্তি, অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ, সার্টিফিকেট প্রদান এমনকি রোগীর লাশ ছাড় প্রদানের ক্ষেত্রেও চাহিদামাফিক টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য সেক্টরে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, বিদেশে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণের অনুমোদন পেতেও মোটা অঙ্কের টাকা লাগে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর ঘুষ লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেক্টরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে শিক্ষা সেক্টর। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনপ্রাপ্তি, এমপিওভুক্তিকরণ, শিক্ষকের পেনশন তোলা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে টাকার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা ভবনে যে কোনো কাজের জন্য হাজির হলেই যেন রেহাই নেই, টেবিলে টেবিলে টাকা গুনে দিয়ে তবেই শিক্ষকদের নিস্তার মেলে। এসব শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানে ফিরে নানা খাতে, ফন্দিফিকিরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই সে টাকা তুলে নিতে বাধ্য হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ; স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ভুক্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, বিআরটিএ দফতরে সরকারি ফি পরিশোধের আগে ঘুষের টাকা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক বিধান (!) হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা, কানুনগো, সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে গ্রামীণ পর্যায়ের তহশিল অফিসও ঘুষের আখড়া হয়ে উঠেছে। নগরীর সেবা খাত বিশেষ করে সিটি করপোরেশন, গ্যাস, বিদ্যুত্, ওয়াসার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের ধাপে ধাপে শুধু ঘুষের ছড়াছড়ি। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৭ খাতে ঘুষ না দিয়ে পেনশন পাওয়ার কোনো উপায় নেই। ইদানীং ঘুষ লেনদেন এতটাই বৈধতা (!) পেয়ে গেছে যে, বেশির ভাগ দফতরের কাজের ধরন অনুযায়ী কত টাকা ঘুষ দিতে হবে তা ভুক্তভোগীদেরও মুখস্থ রয়েছে। সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে রাজধানীর যে কোনো থানায় অন্তত ৫০০, ডিএমপির বাইরের থানাগুলোয় ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ লাগবে— এটা আর কাউকে এখন বলে দিতে হয় না। কেন্দ্রীয় কারাগারে আসামি দেখতে হলে নির্ধারিত টিকিট কাটার পরও ৫০০-৭০০ টাকা জেল পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে— এও কারও অজানা নয়। শুধু যে পুলিশ আর সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়েই এ প্রথা চালু রয়েছে তা নয়, মানুষ বানানোর কারিগর হিসেবে পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়েও ঘুষের বিস্তার ভয়াবহ রূপ পেয়েছে। রাজধানীর নামিদামি সরকারি-বেসরকারি স্কুলের প্রাথমিক শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তি করার ক্ষেত্রেও এক থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যন্ত সব শাখাতেই শ্রেণিমাফিক ঘুষ দিয়ে তবেই কাজ হাসিল করতে হয়। বিমানের কার্গো থেকে পণ্য ছাড়াতে ঘুষ লাগে ৬০ ঘাটে! ঘুষের এ হার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকার বেশি। জরুরি হলে গুনতে হয় দ্বিগুণের বেশি। ঘুষ ছাড়া কোনো পণ্য বের হওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ বিমান, কুরিয়ার সার্ভিস আর কাস্টমসের একটি সিন্ডিকেট এ ঘুষবাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঘুষ প্রদানে অনীহার কারণে একটি ফ্লাইট অবতরণের পর ২০-২৫ দিনের আগে পণ্য খালাস সম্ভব হচ্ছে না। ছাড় না পাওয়ায় পণ্যগুলো বিমানবন্দরের রানওয়ের খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে পচতে থাকে। এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট কার্টন ভেঙে, পলিথিন খুলে হরহামেশা চুরি করে নিয়ে যায় শত শত কোটি টাকার মূল্যবান পণ্য। পৈতৃক ভিটেমাটি হুকুমদখল করে নেওয়ার ক্ষতিপূরণ তুলতেও শতকরা ১০-১৫ ভাগ হারে ঘুষ দিতে হয়। বিভিন্ন ছুটিতে ঘরে ফিরতে ট্রেন-বাসের টিকিট সংগ্রহের জন্য দিতে হয় ঘুষ। পানি, বিদ্যুত্, গ্যাস, টেলিফোন লাইন পেতে দিতে হয় ঘুষ। পোস্ট অফিসে বেশি চিঠি নিয়ে গেলে, ফেরি পারাপারে টেন্ডারে কাজ পেতে, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য বাজারজাত করতে, দালান তৈরির অনুমোদন পেতে ঘুষের কোনো বিকল্প নেই। সরকারি যেসব দফতর-অধিদফতরে টেন্ডার কার্যক্রম সচল রয়েছে সেগুলোতে টাকার লেনদেন এখন ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানির লেনদেনকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর