রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুর্ভোগ সচেতনতার অভাবে

দুর্ভোগ সচেতনতার অভাবে

সচেতনতার অভাবে দুর্ভোগ বাড়ছে রাজধানীতে। ফুটওভারব্রিজ রেখে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, তীব্র শব্দে হর্ন দেওয়া, ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানো, যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা— সবই যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আইন থাকলেও যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। নাগরিক জীবনের নানা দুর্ভোগের চিত্র সরেজমিন তুলে ধরেছেন জুলকার নাইন, মাহমুদ আজহার, জিন্নাতুন নূর ও রফিকুল ইসলাম রনি   ছবি : রোহেত রাজীব

 

ব্যস্ত রাস্তায় একের পর এক আসা দ্রুতগতির গাড়ির সামনে দিয়ে এপার থেকে দৌড়ে ওপারে চলে যাচ্ছেন শিশু কোলে নিয়ে মা। ফুটওভারব্রিজের ঠিক নিচে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন শহুরে শিক্ষিত নাগরিকরা। একবার হাত দেখিয়েই যেন থামিয়ে দিচ্ছেন দানবের গতিতে আসা বাস-ট্রাক। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের চালকেরা মানছেন না কোনো সিগন্যাল। চার রাস্তার মোড়ে সিগন্যাল পরিবর্তনের সময়টাকেই যাতায়াতের সময় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বাইকাররা। সকালে গৃহস্থালির আবর্জনা রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনের বাইরে ছুড়ে এসে কর্মজীবী নাগরিকরা সারা দিন রাস্তায় অবলীলায় ফেলছেন থুথু, পানের পিক বা খাবারের প্যাকেট। পরিচ্ছন্নতা দূরের কথা, পেছনে কারও গায়ে লাগছে কি না সেদিকেও নেই খেয়াল। স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষই জনসমাগম স্থানে শিশুর পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে ওড়াচ্ছেন বিষাক্ত নিকোটিন। যানজট দেখলেই বিধি লঙ্ঘন করে লাগানো ভিআইপি সাইরেন বাজিয়ে উল্টোপথে (রং সাইড) গাড়ি চালাচ্ছেন চালক। পেছনে বসে তাকে নির্দেশনা বা উত্সাহ দিচ্ছেন উচ্চবিত্তরা। চালকের আসনে থাকা ব্যক্তি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তীব্র হর্ন বাজিয়ে কানের বারোটা বাজাচ্ছেন সাধারণ মানুষের। যানজটের রাস্তায়ও গাড়ি পার্ক করে রাখা হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর সবই রাজধানী ঢাকার প্রতিদিনকার চিত্র। নাগরিক জীবনে প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে বছরের পর বছর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই। গত তিন দিন ঢাকার বিভিন্ন অংশ ঘুরে এ অবস্থারই পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা। ঢাকার সবচেয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি-চলা বিমানবন্দর সড়কের শেওড়া অংশে দেখা গেল, পাঁচ বছরের আইমানকে কোলে করে রোড ডিভাইডার পার হচ্ছেন বাবা শাকিল আহমেদ। আইমানকে ডিভাইডারের ওপর রেখে নিজে রাস্তায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সাদা রঙের এলিয়ন প্রাইভেটকারের প্রায় সামনে এসে পড়েন। হকচকিত চালক তত্ক্ষণাত্ বাঁ দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িচাপা থেকে বাঁচালেন শাকিলকে। কিন্তু প্রাইভেটকারটির লুকিং গ্লাস লেগে যায় পাশেই দ্রুতগতিতে থাকা প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে। সৌভাগ্যক্রমে ঘটেনি কোনো হতাহতের ঘটনা। পরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে শাকিল জানান, পাশেই ওভারব্রিজ দেখেছিলেন। হাতে সময়ও ছিল। কিন্তু গত ২৩ বছর ঢাকায় বসবাসে হওয়া বদভ্যাস থেকেই তিনি সরাসরি রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়া শাকিল প্রাণ ফিরে পেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছেন, আর কখনো এমন ভুল করবেন না। ঠিক একই সময় রাজধানীর আরেক প্রান্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের উত্তর পাশের রাস্তায় খুব একটা যানজট ছিল না। মিরপুর থেকে ছেড়ে আসা মতিঝিলগামী শিকড় ও বিকল্প পরিবহন পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছুটে আসছিল। গাড়ি দুটি যখন বিএমএ মিলনায়তনের সামনে পৌঁছায় তখন সামনে দিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হতে দৌড় দেন আবদুল হালিম মণ্ডল নামের এক বৃদ্ধ। বয়স ৬৫। শিকড় পরিবহনের গাড়িটি দ্রুত চলে গেলেও বিকল্প পরিবহনের চালক কড়া ব্রেক কষে গাড়ি থামান। পরে ওই বৃদ্ধকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন চালক জামিনুল। এ সময় আলাপকালে জামিনুল বলেন, ‘উল্টাপাল্টা দৌড়ায় আর মরলে গাড়ি ভাঙচুর করে মানুষ। একই সঙ্গে আমাদের আসামি করা হয়।’ শুধু আবদুল হালিম মণ্ডলই নন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গতকাল মত্স্য ভবনের সামনে রাস্তা পারাপার হতে দেখা গেছে শতাধিক পথচারীকে। তাদের একজন সুমি ইসলাম। বাসা রাজধানীর শাহজাহানপুরে। সুপ্রিমকোর্টে এসেছিলেন তিনি মামলা-সংক্রান্ত কাজে। কেন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হলেন—জানতে চাইলে সুমি বলেন, ‘সবাই তো হচ্ছে। তাই আমিও হলাম।’ শাহবাগ থেকে প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশে বাস থেকে নামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফেরদৌস দৌড়ে রাস্তা পার হলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন, সময় বাঁচানোর জন্যই ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। প্রেসক্লাব এলাকায় পোশাকশ্রমিকদের এক সমাবেশে যোগ দিতে আসা মধ্যবয়সী মরিয়ম রাস্তা পার হলেন কোনো দিকে না তাকিয়েই। জানতে চাইলে বললেন, ‘সবাই পার হয়। তাই আমিও এভাবেই পার হলাম। ব্রিজে উঠতে পরিশ্রম হয় অনেক।’ মন্ত্রিপাড়া হেয়ার রোডের একটু উত্তরে চোখে পড়ে ডিএমপির পক্ষ থেকে লেখা আছে—‘উল্টোপথে গাড়ি চালাবেন না’। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সরেজমিনে দাঁড়িয়ে প্রধান বিচারপতির বাড়ির সামনে থেকে উল্টোপথে ২৬টি মোটরসাইকেল যেতে দেখা গেল মাত্র ৫০ মিনিটে। এ ছাড়া ভিআইপি হর্ন বাজিয়ে পার হতে দেখা গেল একটি পাজেরো ও একটি মার্সিডিজ গাড়ি। অবশ্য অফিসার্স ক্লাব মোড়ের বিপরীতে সম্প্রতি বসানো চাকা ফুটোর যন্ত্র গতকাল ঠিক ছিল। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দেখে ফের ফেরত এসে স্বাভাবিক পথেই মগবাজারের দিকে গেল যানবাহনগুলো। তবে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল চাকা ফুটোর যন্ত্র দেখে উঠে গেল ফুটপাথে। এরপর বিপরীত পাশের ফুটপাথ ব্যবহার করেই চলে গেল সেগুলো। তবে ডিবি অফিসের মোড়ে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িও দেখা যায় উল্টোপথে মগবাজারের দিকে যেতে।

মিরপুরে কালশীর নতুন রাস্তায় দেখা গেল, দ্রুতগতিতে থাকা বাসে ওঠার জন্য হাত দেখালেন এক যাত্রী। বাসও থেমে গেল। যাত্রীকে তুলে নেওয়া হলো। বাসের পেছনে দ্রুতগতির গাড়িগুলোকেও তাই থেমে যেতে হলো অপ্রস্তুতভাবে। একই চিত্র দেখা গেছে মানিক মিয়া এভিনিউ ও বিমানবন্দর সড়কে। সিটি কলেজের বিপরীত মোড়ে সিগারেটের দোকান ঘিরে ধূমপান করছিলেন আধা ডজন লোক। পাশেই বাসের অপেক্ষায় থাকা মোহাম্মদপুরের গৃহিণী সালমা বিনতে সোলাইমানকে দেখা গেল মুখ ওড়না দিয়ে ঢাকতে। তার অবস্থা দেখেও পাশে থাকা তরুণ ছাত্র ধূমপায়ীদের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। একপর্যায়ে তরুণদের উদ্দেশে সালমা বলেই ফেললেন, ‘সিগারেটটা তো ডাস্টবিনে বসেও খেতে পার!’ একই চিত্র দেখা গেল শাহবাগ মোড়ে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের পাশে দেড় বছরের শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সিএনজি অটোরিকশা খুঁজছিলেন মিরপুরের রাশেদ। কিন্তু তার স্ত্রী ও সন্তানের ঠিক পাশে দাঁড়িয়েই সিগারেট ও পান খাচ্ছিলেন হাসপাতালের টেকনিশিয়ান মানিক। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মানিক রাস্তায় ফেলছিলেন পানের পিক। কিন্তু কেন—জানতে চাইলে মানিক বললেন, ‘সরকারি রাস্তা। কারও তো কোনো এটা নিজস্ব সম্পত্তি না!’

দেশের প্রবীণ নাগরিক ও অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল বিষয়গুলো। এ বিষয়ে তিনি বললেন, ‘আমরা নাগরিকরাই খামখেয়ালি আচরণ করে চলেছি। একে আর যা-ই হোক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকত্ব বলা যায় না। রাস্তার যে কোনো ভোগান্তিতে আমরা সরকার ও প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করছি। কিন্তু নিজের শহরকে বাসযোগ্য রাখার জন্য বা রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষায় নিজ দায়িত্বটুকু আমরা নাগরিকরা পালন করছি না। অথচ নিজ শহরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রধানতম দায়িত্ব আমাদের নাগরিকদেরই। নাগরিকরা যদি দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন আচরণ করেন এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে সরকার বা নগরের সেবকরা কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ পাবেন না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর